
Home সাংবাদিক / Journalist > গোলাম মাজেদ / Gholam Majed (1928-1984)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99993 বার পড়া হয়েছে
গোলাম মাজেদ / Gholam Majed (1928-1984)
গোলাম মাজেদ
Gholam Majed
Home District: Jessore
Gholam Majed
Home District: Jessore

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা একটি নাম গোলাম মাজেদ। গোলাম মাজেদ সর্বপ্রথম বাঙ্গালী যার ছবি বিশ্বের বরণীয় সাংবাদিকদের তালিকায় স্থান পেয়েছে। যশোরের চৌগাছা উপজেলার নারায়নপুর গ্রামের প্রখ্যাত মিয়া বাড়ীর বংশধর জনাব গেলাম মাজেদ ১৯২৮ সালের ১ মার্চ পশ্চিম বঙ্গের আন্দুলিয়া গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুর রউফ ছিলেন একাধারে একজন সুপণ্ডিত শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমাজ সেবক ও গবেষক। তাঁর পিতমহ খানসাহেব আব্দুল আজিজ ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় (যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া ও বনগাঁ এলাকা) আইন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য (MLC)।
মাত্র দেড় বৎসর বয়সে ১৯৩০ সালে তাঁর মাতৃবিয়োগ ঘটে। অতঃপর তিনি তাঁর বড় চাচী, ফুপুসহ অন্যান্যদের স্নেহে যত্নে বড় হতে থাকেন। ৭ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে গোলাম মাজেদ ছিলেন সবার বড়।
গোলাম মাজেদের ১৯ --- সালে যশোর শহরতলী পুলের হাট এলাকার মেয়ে রাবেয়া খাতুনের সাথে বৈবাহিক জীবন শুরু হয়। তিনি ৪ পুত্র ও ৫ কন্যা সন্তানের জনক। বড় পুত্র সাইফুল আলম (মুকুল) ও ছিলেন পিতার মত একজন নির্ভিক সাংবাদিক। পিতার পথ অনুসরণ করতে গিয়ে তাঁকেও জীবন হয়েছে ১৯৯৮ সালে আততায়ীর শক্তিশালি বোমার আঘাতে। মেঝ কন্যা ২০০১ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রান হারান। সেজ পুত্র মনজুরুল আলম (টুটুল) বর্তমান রানার পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
শিক্ষাজীবন:
পারিবারিক সূত্রে শৈশব ও কৈশোরের এক বিরাট অংশ অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কোলকাতায় অতিবাহিত হয়। ৩৯/১ কলিন স্ট্রিট ছিল তাঁর পিতার আবাসস্থল। কলকাতা হেরার স্কুলে তিনি নবম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। ১৯৪২ সালে তিনি সকলের অজ্ঞাতে গৃহত্যাগ করেন এবং পরবর্তী দুই বছর গোটা ভারত পরিভ্রমণ করেন। ১৯৪৪ সালে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার কোটচাঁদপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে অনিয়মিত ছাত্র হিসাবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
পেশাগত জীবন:
১৯৪৫ সালে সিভিল সাপ্লাইয়ের চাকরিতে যোগদানের মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। ১৯৫৪ সালে সিভিল সাপ্লাই অবলুপ্ত হবার পর ১৯৫৬ সালে তিনি খাদ্য বিভাগের চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি সার্কেল অফিসার (রাজস্ব) হিসাবে রাজশাহী জেলায় গোদাগাড়ীতে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন।
সাহিত্যচর্চা:
গোলাম মাজেদ চাকরিজীবনের ব্যস্ততার মাঝেও নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। গল্প, ক

তিনি স্থানীয় সাহিত্য সেবীদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করতেন ও নিয়মিত যোগ দিতেন সাহিত্য আসরসমুহে।
বিজ্ঞান মনস্ক অনুসন্ধিৎসা:
মরহুম মাজেদের ছিল বিজ্ঞান মনস্ক অনুসন্ধানী দৃষ্টি। গভীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে ষাটের দশকের প্রথম দিকে মৌলিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন এবং শব্দ তরঙ্গ আলোর গতি দূরদর্শন প্রভৃতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন, যা তৎকালে প্রখ্যাত পাকিস্তানী পদার্থবিদ ও বৈজ্ঞানিক জনাব আবদুস সালাম কর্তৃক ব্যপকভাবে প্রশংশিত হয়।
সাংবাদিকতা:
চাকরি থেকে অবসরপ্রপ্তির পর তিনি ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ সময়ে তিনি স্থানীয় পত্র পত্রিকাসমুহে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। অবশেষে তিনি নিজস্ব মালিকানায় পত্রিকা প্রকাশনার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৮ সালের ১৬ জুলাই সাপ্তাহিক গণমানস এর মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর সাংবাদিক জীবন। নিজস্ব প্রকাশনাকে আরও ব্যপক কারার লক্ষ্যে ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ থেকে দৈনিক রানার এর প্রকাশনা শুরু করেন।
পোস্ট অফিসের পিয়নকে আগে বলা হত ‘ডাকহরকরা’। আরেক নাম - ‘রানার’। প্রকৃতির বৈরীতা তার প্রতিপক্ষ ঝড়-বাদল-প্লাবন উপেক্ষা করে ‘রানার’ কে প্রতিদিন ছুটতে হয় অন্যের সুখঃদুখের বাহক হয়ে। নির্ধারিত সময়ে প্রাপকের হাতে পৌঁছে দিতে হয় চিঠিপত্র। প্রাপক তা পড়ে খুশী হন অথবা হন অসন্তুষ্ট, তাতে রানারের কিছুই এসে যায় না। ওই সংবাদটি পৌঁছে দেয়া তাঁর দায়িত্ব। এ উপলব্ধি থেকে ‘সাপ্তাহিক গণমানস’ হতে ‘দৈনিক রানার’ এর জন্ম।
দৈনিক রানার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম গোলাম মাজেদ ছিলেন সার্থক কলম সৈনিক। সাংবাদিকতা হিসাবে জনাব গোলাম মাজেদের প্রধান লক্ষ ছিল সমাজ ও প্রশাসনের সমস্ত দুর্নীতি, অব্যবস্থা, অনৈতিকতা কুসংস্কার, কুপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ এবং সুষ্ঠ ও ইতিবাচক সমাজ রাজনীতি গড়ে তোলা। স্বীয় লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অনমনীয় ও আপোষহীন। ষ্পষ্টবাদীতা ছিল তাঁর চারিত্রের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য।
তাঁর বলিষ্ঠ সম্পাদনায় পত্রিকাটি হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। সমাজের সকল প্রকার অনাচার, প্রশাসনিক দুর্নীতি, ধর্মীয় গোড়ামী, সন্ত্রাস, ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধমূলক কাজ, তাদের হোতা এবং পৃষ্ঠপোষক মহলের বিরুদ্ধে সবসময় প্রতিবাদ করতেন তিনি। সামরিক আইন যে কোনদিন জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে না, তা দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন তিনি তাঁর পত্রিকায়। ফলে সামরিক শাসক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিরাগভাজন হন এবং ফলশ্রুতিতে তাঁকে হতে হয় কারাবন্দী। শুধু বন্দিত্ব নয়, অমানুষিক শারীরিক অত্যাচার করা হয় তাঁর উপর। আর এই আমানুষিক অত্যাচারের কারণেই তাঁকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করতে হয়।
১৮৮১ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস ছাত্তার সাময়িকভাবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। পরবর্তিতে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ আব্দুস ছাত্তারের নিকট থেকে অবৈধ ভাবে ক্ষমতা হস্তগত করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর সামরিক সরকার জেনারেল এরশাদ সামরিক আইন জারী করেন।
১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে রানারের প্রথম সংখ্যায় প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শহীদ গোলাম মাজেদ লিখেছিলেন : “২৬ মার্চ সাহসী ইতিহাস সৃষ্টির দিন।” সে সাহস তিনি দেখালেন ১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করে। লিখলেন: নির্যাতকের ভূমিকা পরিহার করুন” কি বিষ্ময়কর ব্যাপার ! কি দুঃসাহস ! কি অমিত তেজ সাংবাদিকতা !!! এর মাত্র ৪৮ ঘন্টা আগে ২৪ মার্চ রাত ১১টায় জেনারেল এরশাদ মার্শাল’ল জারি করেন। রেডিও-টিভিতে আধঘণ্টা অন্তর অন্তর প্রচার চলছে - “সামরিক বাহিনির কোনরূপ সমালোচনা দন্ডনীয় আপরাধ।” সিংহপুরুষ গোলাম মাজেদ তা মানলেন না। অতঃপর তিনি ২৯ শে মার্চ গ্রেফতার হলেন।
স্বৈরশাসক দীর্ঘ ৮দিন তাঁকে আজ্ঞাতস্থানে রেখে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায় এবং জিঘাংসাবৃত্তি পূরনে প্রহসন মূলক বিচারের নামে তাঁকে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু দেশী -বিদেশী মানবাধিকার সংস্থার ও সাংবাদিকদের চাপের মুখে ‘৮২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। গোলাম মাজেদ আবারও তেজোদিপ্ত কণ্ঠে গর্জে ওঠেন। এরশাদের পুত্র সন্তান লাভ সংক্রান্ত মিথ্যাচারসহ কয়েকটি বিষয়ে তিনি কঠোর ভাষায় প্রবন্ধ লেখেন ‘চাদর ও মাজারের মাহাত্ন্য নয়’ শিরোনামে। সামরিক জান্তা অগ্নিশর্মা হয়ে ১৯৮৩ সালের ১৯ ফ্রেব্রুয়ারী তাঁকে আবারো যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করে। সামরিক আদালতে একতরফা বিচারে গোলাম মাজেদকে ৩ বৎসরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় তাঁর উপর। সাংবাদিক গোলাম মাজেদ তবুও দমলেন না। ‘ইমলী’ ছদ্মনামে কারাগারে বসে লিখে গোপন প্রতিক্রিয়ায় পাঠাতে লাগলেন। এর পাশাপাশি সামরিক শাসনের প্রতিবাদে বন্দীবিদ্রোহে’র প্রচেষ্টা নেন। বিষয়টি আগেভাগে জানতে পেরে কর্তৃপক্ষ তাঁকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সিলেট কারাগারে পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।
মৃত্যু:
অমানুষিক নির্যাতনের ফলে গোলাম মাজেদের শরীর ভেঙ্গে পড়ে। অবস্থার চরম অবনতি হয়। অগত্যা এরশাদ সরকার “হত্যার দায় এড়াতে” ১৯৮৪ সালের ৫ এপ্রিল গোলাম মাজেদকে মুক্তি দেয়। ৭ এপ্রিল রাত সাড়ে ৩টায় তিনি সিলেট থেকে যশোরে পৌঁছান। সে সময় শারিরীক দিক থেকে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড দূর্বল। মাত্র ৫ দিন অতিবাহিত হয়। ১০ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে বুকে প্রচণ্ড যন্ত্রনা অনুভব করতে থাকেন। তাঁর শরীরের তাপ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকলে চিকিৎসক বন্ধু ডাঃ রবিউল হকের পরামর্শ ক্রমে তাঁকে যশোর সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকগণ দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে তৎপর হন। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা অক্লান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও চিকিৎসকরা তাঁকে বাঁচাতে ব্যর্থ হন। বিকাল ৪:৩৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ঐ দিনই যশোরের স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র জনতা সাংবাদিক গোলাম মাজেদকে সংবর্ধনা দেবার আয়োজন করেন। কোতয়ালী থানা চত্বরের চৌরাস্তায় মঞ্চ সাজানো হয়। এরই মধ্যে আসে অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ -- গোলাম মাজেদ আর নেই। মুহুর্তে হাসপাতালে উপচে পড়া ভীড়।
১০ এপ্রিল ’৮৪’র সেই সংবর্ধনা মঞ্চে জীবিত গোলাম মাজেদের পরিবর্তে মৃত গোলাম মাজেদ উপস্থিত হলেন। স্বামীর মৃতদেহ সামনে রেখে বক্তব্য রেখেছিলেন রানারের প্রকাশিকা রাবেয়া খাতুন। বলেছিলেন, স্বৈরাচারী সরকার পরিকল্পিতভাবে সাংবাদিক গোলাম মাজেদকে হত্যা করেছে। তিনি এর বিচার চেয়েছিলেন জনতার কাছে। যশোরের ছাত্র-জনাতা সেদিন শপথ নিয়েছিলেন-খুনী এরশাদ উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার। ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটলে সবচেয়ে বেশী খুশী হয়েছিল দৈনিক রানার। পরদিন রানারের হেডপিস ছাপা হয় নীচে। উল্টোভাবে। আর উপরে হেডপিসের স্থানে ছাপা লীড নিউজ শিরোনাম : গোলাম মাজেদের খুনী এরশাদ শাহীর পতন।
তথ্য সূত্র:
দৈনিক রানার
সম্পাদনা:
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আামিন শান্ত
তথ্য সরবরাহ:
শিরিন আক্তার বকুল
সর্বশেষ আপডেট:
ফেব্রুয়ারী ২০১২