
Home ক্রীড়াবিদ / Players > সাকিব আল-হাসান / Shakib Al-Hasan (1987)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100115 বার পড়া হয়েছে
সাকিব আল-হাসান / Shakib Al-Hasan (1987)
সাকিব আল-হাসান
Shakib Al-Hasan
Home District: Magura

সাকিব আল হাসান সারা বিশ্বের ক্রিকেট অঙ্গণের একজন ধ্রুবতারা। এলজি আইসিসি আ্যওয়ার্ড ২০০৯ এ সাকিব দুই ক্যাটাগরিতে মনোনিত হয়েছেন। ওয়ানডে ক্রিকেট র্যাকিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর অল রাউন্ডার সাকিব আইসিসির বর্ষসেরা পুরষ্কারের জন্য মনোনিত ১৪ জনের তালিকার একমাত্র বাংলাদেশী খেলোয়ার। ২০১১ সালে মনোনিত হয়েছেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার। ২০০৮ সালে সাকিব বর্ষসেরা এমার্জিং খেলোয়ার হিসাবে তালিকায় ছিলেন। ইংরাজী ২০০৮ সালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৯৬ রানে ৪ উইকেট লাভ করে আইসিসি পুরস্কার জন্য মনোনীত হন এবং ২০০৮ সালের ১ অক্টোবর জোনানেসবার্গে অন্যান্য বিজয়ীদের সাথে তাঁকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পুরস্কৃত করা হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকাদের পারফরমেন্স বিচারে সাকিব আল হাসানের মত ধারাবাহিক ভাল পারফরমেন্স করা ক্রিকেটারের সংখ্যা এ দেশে খুব কমই জন্ম নিয়েছে। এক সময়ে এই অল রাউন্ডারের পারফমেন্স ফসলই আই.সি.সি নির্বাচক প্যানেলের মনোনয়নে বর্ষসেরা ক্রিকেটার এবং বর্ষসেরা টেষ্ট ক্রিকেটার হিসেবে সাকিবের নাম সামনে চলে আসে। আর বিশ্বের সেরা অল রাউন্ডার হিসেবে সেই তালিকার শীর্ষ হিসেবে নিজের স্থান দখল করার দৌড়ে সাকিব যে অনেকখানি এগিয়ে রয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নাই। এক সময়ে সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং তিনি দায়িত্বপালনকালীন সময়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে তার দল স্থান পায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক আশরাফি বিন মর্তুজার ইনজুরির কারণে দলকে নেতৃত্বদানেও সাকিবের প্রগাঢ় ক্রিকেটিয় জ্ঞান প্রমাণিত হয়েছে। সকিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্যারিয়িয় সফরে দুই ম্যাচের টেষ্ট সিরিজ ২-০ ব্যবধানে জয়লাভ করে প্রথমবারের মত বিদেশের মাটিতে টেষ্ট সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব লাভ করে। একই সাথে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও ক্যারিবীয়দের হোয়াইট ওয়াস করতে কোন কার্পণ্য করেনি সাকিব বাহিনী। ক্যারিবিয়দের বিপক্ষে এই টেষ্ট সিরিজ ১৩ উইকেটে এবং ১৫৯ রান করে দ্বিতীয় টেষ্ট সেরা খেলোয়ার এবং সিরিজ সেরা খেলোয়ারের পুরষ্কার ছিনিয়ে নেন সাকিব। ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচের ৬৫ রান ও ১ উইকেট তুলে নিয়ে ওয়েষ্ট ইন্ডিজকে ৩ উইকেটে পরাজিত করে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। এই সিরিজের পরে জিম্বাবুয়ের মাটিতে অনুষ্ঠিত ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ৪-১ ব্যবধানে জয়ী হয় সাকিবের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ম্যাচে ১০৪ রান করে হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা। প্রথম ৬ টেষ্টে মাত্র ৩ উইকেট দখল করা বাংলাদেশের অন্যতম এই অলরাউন্ডার গত ৮ টেষ্টে ৪৫ উইকেট নিয়ে নিজের যোগ্যতার যথাযথ প্রমাণই দিয়েছেন। ম্যাচে পরাজিত হয়েও অল রাউন্ডার পারফরমেন্সের জন্য সাকিবের ম্যাচ সেরার প্রমাণও রয়েছে। ২০১০ বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম টেষ্টে শ্রীলংকা ১০৭ রানে জয়ী হলেও দুই ইনিংস মিলিয়ে ৬ উইকেট এবং ১২২ রান করার সুবাদে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন সাকিব। ঐ বছরে এই অলরাউন্ডার পারফরমেন্সের ফসলই আই.সি.সি নির্বাচক প্যানেলের মনোনয়নে বর্ষসেরা ক্রিকেটার এবং বর্ষসেরা টেষ্ট ক্রিকেটার হিসেবে সাকিবের নাম সামনে চলে আসে। আর বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে সেই তালিকার শীর্ষে হিসেবে নিজের স্থান দখল করার দৌড় সাকিব যে অনেকখানি এগিয়ে রয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নাই। ২০০৯ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ওয়ানডে র্যাংকিয়ের শীর্ষে ছিলেন সাকিব। এপ্রিলে অস্টেলিয়ার শের্ন ওয়ার্টশনের কাছে শীর্ষ স্থান হারালেও ৭ মাসের মাথায় শীর্ষে ফিরেন দেশ সেরা অলরাউন্ডার সাকিব। জিম্বাবুয়ে সফরে দলের ব্যার্থতার পর জাতীয় দলের নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে হয় সাকিবকে। সে সময়ে বলেছিলেন দায়িত্ব না থাকায় এখন নির্ভর হয়ে খেলতে পারবেন তিনি। নিজের সেই সাভাবিক খেলা খেলে পরাজিত দলে থেকেও বিশ্বসেরা সাকিব আল হাসান।
এখন পর্যন্ত ২৬ টি টেস্ট খেলে দুইটি শতক ও ১২৬টি ওডিআই খেলে ৫টি শতক। এছাড়া বোলিং এ টেস্টে ৯৬ টি ও ওয়ানডে তে ১৬০টি উইকেট দখলে এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এর।
~সাকিবের কয়েকটি অর্জন~
•• '’Wisden Test cricketer of the Year’' - 2009 নির্বাচিত।
•• ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশী খেলোয়াড় হিসেবে ইংলিশ কাউন্ট্রি খেলতে যাওয়া।
•• ২০১০ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ওডিআই উইকেট নেওয়া।
•• ২০১০ সালে আইসিসি কতৃক বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার নির্বাচিত। এবং এখনো ধরে রেখেছেন কৃতীত্বের সাথে।
•• তার অধীনে বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়।
এই কয়েকটি অর্জন দিয়ে সাকিবকে মূল্যায়ন করা যাবে না। যাবে না কয়েকটি কথা বলেও। সাকিবের মূল্যায়ন সাকিব নিজেই। নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান, নিজেই একটি পরিসংখ্যান।
বাবা চেয়েছিলেন ফুটবলার হোক সাকিব
বাবা মাশরুর রেজা কুটিল চেয়েছিলেন ছেলে ফুটবলার হোক। সে লক্ষ্যেই তিনি ছেলেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। অথচ ছেলেটি হল কিনা ক্রিকেটার। শুধু তাই নয়; বিশ্বক্রিকেটে সে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শীর্ষ একজন অলরাউন্ডার হিসেবে, দেশকে এনে দিচ্ছে অনেক গৌরবগাঁথা। মাগুরায় ফয়সাল নামে পরিচিত সেই ছোট্ট ছেলেটি অবশ্য দেশে-বিদেশে সাকিব আল হাসান নামেই পরিচিত। জাতীয় দলে ভরসার অনন্য উদাহরণ!
এক সময় ফুটবলই ছিল সাকিবের নিত্যসঙ্গী, ফুটবলেই বসতি! এমনকি রাতে ঘুমাতেও যেতেন ফুটবল কোলে নিয়ে। পড়ার টেবিল, বিছানার পাশে, সব জায়গাতেই চোখের সামনে অন্তত একটি বল তার চাই-ই-চাই। বল না হলে তার পড়া, খাওয়া এবং ঘুমের কোনোটাই যেন পূর্ণতা পায়না। এ জন্য মায়ের বকুনি, বাবার শাসনের বাড়াবাড়িও কম ছিলনা! তাতে অবশ্য ভ্রূক্ষেপ কমই করতেন সাকিব। লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে হবে এটা ছিল পরিবারের প্রথম শর্ত। কিন্তু শেষপর্যন্ত সব শাসন-বাধা উপেক্ষা করে সাকিব চলেছেন নিজের পথেই। ফুটবল আগের মতই টানে আজো। কিন্তু সঙ্গী করেছেন ক্রিকেটকে।
স্কুলে নিয়মিত হাজিরা না দেওয়া, বাড়িতে ঠিকমতো পড়তে না বসা, এসবই ছিল সেদিনের ফয়সালের নিত্য কাজের তালিকায়। সকাল-দুপুর-বিকেল কাটত কেবল দুরন্তপনায়। ফুটবলের পাশাপাশি খানিকটা ক্রিকেট খেলার জন্য সুযোগ পেলেই বাড়ির বাইরে থাকা কেশবমোড়ের সেই ছেলেটি এখন বিশ্ব ক্রিকেটের এক ঝড়ের নাম। এমন কোনো প্রতিপক্ষ নেই যারা তাকে সমীহের চোখে দেখেন না।
সাকিবের স্কুল জীবনের বন্ধু নয়ন খান জানান, মাগুরা শহরের কেশবমোড় এলাকায় বাড়ির পাশে পতিত জমিতেই চলত সাকিবের ফুটবল আর ক্রিকেটের মহড়া। তবে ক্রিকেটটাই বেশি টানত তাকে। পাড়ার ছেলেদের সাথে দল বেধে খেলার মাঝে ডুবে থাকতে যেন তার ভাল লাগত। পথে-ঘাটে, রাস্তায় যেখানেই থাকত, হঠাৎ বোলারদের মতো একটু হাত ঘুরিয়ে নেওয়া বা স্ট্রেইট-ড্রাইভের মত করে কয়েকবার ব্যাট চালানোর ভঙ্গি! যেজন্য বন্ধুরা সেই সময় সাকিবকে ‘বাগানে খেলোয়াড়’ বলে ডাকতাম।
সেদিনের ছোট্ট ফয়সালের খেলোয়াড়ি পথচলার বাঁকে একদিন দৃষ্টি পড়ে মাগুরার একমাত্র ক্রিকেট একাডেমির পরিচালক ও প্রশিক্ষক সাদ্দাম হোসেন গোর্কির। পরে ঐ একাডেমিতে তিন বছর প্রশিক্ষণ নেন সাকিব। এরপর ব্যক্তিগত নৈপুণ্য আর ধারাবাহিক সাফল্যে কেবলই এগিয়ে চলার পালা।
মাগুরা ক্রিকেট একাডেমির ক্রিকেট প্রশিক্ষক সাদ্দাম হোসেন জানান, ১৯৯৮ সালে যখন সাকিব মাগুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, এমন সময় সে তার একাডেমিতে আসে প্রশিক্ষণ নিতে। শৈশবেই মেধাবী তকমা পাওয়া ক্রিকেটার সাকিব সেখানে তিন বছর প্রশিক্ষণ নেয়। তার ক্রীড়া নৈপুণ্যের প্রথম প্রকাশ ঘটে বাগেরহাটে অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেট দলের হয়ে খেলতে নেমে। সেখানে ২২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে আগমনী জানান দেয় সে। এরপর ২০০২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড় হয়ে ঝিনাইদহে মাগুরা জেলা দলের একাদশে খেলার সুযোগ পায়। সেখানে সাকিব ১০৮ রানে নটআউট থেকে ভবিষ্যতের পথে আরেকধাপ এগিয়ে যান। সেই খেলায় কুষ্টিয়া দলকে পরাজিত করে মাগুরা জেলা দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। তাতে অনন্য অবদান ছিল সাকিবের।
এর মাঝেই ২০০১ সালে বিকেএসপি’র ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রামের বাছাইপর্বে নির্বাচিত হন সাকিব। পরবর্তীতে নড়াইলে এক মাসের বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স চলাকালীন সময়েই নির্বাচকদের দৃষ্টিতে কাড়েন সাকিব আল হাসান ফয়সাল। যার ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় দলে অভিষেক। এরপর কেবলই ঊর্ধ্বগামী যাত্রা।
সাকিবের ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মা শিরিন রেজা বলেন, ‘একদিন পড়তে না বসায় রেগে গিয়ে তার প্রিয় ব্যাটটি ভেঙে ফেলি। সেদিন ভীষণ কান্না করেছিল ফয়সাল! খুব কষ্ট পেয়েছিল। রাতে অভিমানী কণ্ঠে নিজের ক্রিকেট ব্যাটের প্রিয়তার কথা বোঝালো আমাকে। খুব মনে আছে সেদিনের কথা।’
মাগুরার এক সময়ের কৃতি ফুটবলার সাকিবের বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা মাশরুর রেজা কুটিলও শোনালেন অন্যরকম এক গল্প। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলব এমন ইচ্ছেতেই প্রতিদিন স্টেডিয়ামে নিয়ে যেতাম। অথচ সে হয়ে গেছে ক্রিকেটার। তবে আমি যা-ই চাই না কেন, ছেলের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি সব সময়। এখনও সেভাবেই চলছে সব।’
সব সাকিবের মত চললেও বাবার সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বিশ্ব-নন্দিত এই ক্রিকেটারকে! মাশরুর রেজা ছেলের খেলার সমালোচনা করে থাকেন অন্যদের মতোই! সমালোচনা করেন প্রতিটি বিষয়ের। তবে মাঠে বা টিভিতে খেলা দেখেন না। জানালেন, ‘মাঠে বসে বা টিভিতে সরাসরি খেলা দেখার প্রতি আমার প্রচণ্ড অনাগ্রহ। ক্রিকেটে প্রতি বলেই থাকে অনিশ্চয়তা-উত্তেজনা। ছেলে ব্যর্থ হলে সেই উত্তেজনা অন্য সবার থেকে আমাকে বেশি আঘাত করে। যে কারণে সেই উত্তেজনা থেকে দূরে থাকতে পরে ধারণকৃত খেলা দেখে নেই।’
একটু একটু করে বেড়ে ওঠা মায়ের আদুরে সেই ফয়সাল আজকের সাকিব হয়ে উঠে ধারাবাহিক নৈপুণ্যে ক্রিকেট দুনিয়ার আলোচিত ব্যক্তিত্ব। দেশ-বিদেশের ক্রিকেট বিশ্লেষকদের আলোচনায় নিয়মিতই উঠে আসে তার নাম। লাল-সবুজদের গৌরবের চরিত্র। ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার আগে নিশ্চিতভাবেই পৌঁছে যাবেন আরো অনেক অজানা শিখরে।
তথ্যসূত্র :
মাগুরা এডুকেশন ডিরেক্টরি
(ডা: আবুল কাশেম শিক্ষা ফাউন্ডেশন-২০০৮)
আবু বাসার আখন্দ
সাংবাদিক, মাছরাঙ্গা টেলিভিশন
এক সময় ফুটবলই ছিল সাকিবের নিত্যসঙ্গী, ফুটবলেই বসতি! এমনকি রাতে ঘুমাতেও যেতেন ফুটবল কোলে নিয়ে। পড়ার টেবিল, বিছানার পাশে, সব জায়গাতেই চোখের সামনে অন্তত একটি বল তার চাই-ই-চাই। বল না হলে তার পড়া, খাওয়া এবং ঘুমের কোনোটাই যেন পূর্ণতা পায়না। এ জন্য মায়ের বকুনি, বাবার শাসনের বাড়াবাড়িও কম ছিলনা! তাতে অবশ্য ভ্রূক্ষেপ কমই করতেন সাকিব। লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে হবে এটা ছিল পরিবারের প্রথম শর্ত। কিন্তু শেষপর্যন্ত সব শাসন-বাধা উপেক্ষা করে সাকিব চলেছেন নিজের পথেই। ফুটবল আগের মতই টানে আজো। কিন্তু সঙ্গী করেছেন ক্রিকেটকে।
স্কুলে নিয়মিত হাজিরা না দেওয়া, বাড়িতে ঠিকমতো পড়তে না বসা, এসবই ছিল সেদিনের ফয়সালের নিত্য কাজের তালিকায়। সকাল-দুপুর-বিকেল কাটত কেবল দুরন্তপনায়। ফুটবলের পাশাপাশি খানিকটা ক্রিকেট খেলার জন্য সুযোগ পেলেই বাড়ির বাইরে থাকা কেশবমোড়ের সেই ছেলেটি এখন বিশ্ব ক্রিকেটের এক ঝড়ের নাম। এমন কোনো প্রতিপক্ষ নেই যারা তাকে সমীহের চোখে দেখেন না।
সাকিবের স্কুল জীবনের বন্ধু নয়ন খান জানান, মাগুরা শহরের কেশবমোড় এলাকায় বাড়ির পাশে পতিত জমিতেই চলত সাকিবের ফুটবল আর ক্রিকেটের মহড়া। তবে ক্রিকেটটাই বেশি টানত তাকে। পাড়ার ছেলেদের সাথে দল বেধে খেলার মাঝে ডুবে থাকতে যেন তার ভাল লাগত। পথে-ঘাটে, রাস্তায় যেখানেই থাকত, হঠাৎ বোলারদের মতো একটু হাত ঘুরিয়ে নেওয়া বা স্ট্রেইট-ড্রাইভের মত করে কয়েকবার ব্যাট চালানোর ভঙ্গি! যেজন্য বন্ধুরা সেই সময় সাকিবকে ‘বাগানে খেলোয়াড়’ বলে ডাকতাম।
সেদিনের ছোট্ট ফয়সালের খেলোয়াড়ি পথচলার বাঁকে একদিন দৃষ্টি পড়ে মাগুরার একমাত্র ক্রিকেট একাডেমির পরিচালক ও প্রশিক্ষক সাদ্দাম হোসেন গোর্কির। পরে ঐ একাডেমিতে তিন বছর প্রশিক্ষণ নেন সাকিব। এরপর ব্যক্তিগত নৈপুণ্য আর ধারাবাহিক সাফল্যে কেবলই এগিয়ে চলার পালা।
মাগুরা ক্রিকেট একাডেমির ক্রিকেট প্রশিক্ষক সাদ্দাম হোসেন জানান, ১৯৯৮ সালে যখন সাকিব মাগুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, এমন সময় সে তার একাডেমিতে আসে প্রশিক্ষণ নিতে। শৈশবেই মেধাবী তকমা পাওয়া ক্রিকেটার সাকিব সেখানে তিন বছর প্রশিক্ষণ নেয়। তার ক্রীড়া নৈপুণ্যের প্রথম প্রকাশ ঘটে বাগেরহাটে অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেট দলের হয়ে খেলতে নেমে। সেখানে ২২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে আগমনী জানান দেয় সে। এরপর ২০০২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড় হয়ে ঝিনাইদহে মাগুরা জেলা দলের একাদশে খেলার সুযোগ পায়। সেখানে সাকিব ১০৮ রানে নটআউট থেকে ভবিষ্যতের পথে আরেকধাপ এগিয়ে যান। সেই খেলায় কুষ্টিয়া দলকে পরাজিত করে মাগুরা জেলা দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। তাতে অনন্য অবদান ছিল সাকিবের।
এর মাঝেই ২০০১ সালে বিকেএসপি’র ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রামের বাছাইপর্বে নির্বাচিত হন সাকিব। পরবর্তীতে নড়াইলে এক মাসের বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স চলাকালীন সময়েই নির্বাচকদের দৃষ্টিতে কাড়েন সাকিব আল হাসান ফয়সাল। যার ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় দলে অভিষেক। এরপর কেবলই ঊর্ধ্বগামী যাত্রা।
সাকিবের ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মা শিরিন রেজা বলেন, ‘একদিন পড়তে না বসায় রেগে গিয়ে তার প্রিয় ব্যাটটি ভেঙে ফেলি। সেদিন ভীষণ কান্না করেছিল ফয়সাল! খুব কষ্ট পেয়েছিল। রাতে অভিমানী কণ্ঠে নিজের ক্রিকেট ব্যাটের প্রিয়তার কথা বোঝালো আমাকে। খুব মনে আছে সেদিনের কথা।’
মাগুরার এক সময়ের কৃতি ফুটবলার সাকিবের বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা মাশরুর রেজা কুটিলও শোনালেন অন্যরকম এক গল্প। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলব এমন ইচ্ছেতেই প্রতিদিন স্টেডিয়ামে নিয়ে যেতাম। অথচ সে হয়ে গেছে ক্রিকেটার। তবে আমি যা-ই চাই না কেন, ছেলের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি সব সময়। এখনও সেভাবেই চলছে সব।’
সব সাকিবের মত চললেও বাবার সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বিশ্ব-নন্দিত এই ক্রিকেটারকে! মাশরুর রেজা ছেলের খেলার সমালোচনা করে থাকেন অন্যদের মতোই! সমালোচনা করেন প্রতিটি বিষয়ের। তবে মাঠে বা টিভিতে খেলা দেখেন না। জানালেন, ‘মাঠে বসে বা টিভিতে সরাসরি খেলা দেখার প্রতি আমার প্রচণ্ড অনাগ্রহ। ক্রিকেটে প্রতি বলেই থাকে অনিশ্চয়তা-উত্তেজনা। ছেলে ব্যর্থ হলে সেই উত্তেজনা অন্য সবার থেকে আমাকে বেশি আঘাত করে। যে কারণে সেই উত্তেজনা থেকে দূরে থাকতে পরে ধারণকৃত খেলা দেখে নেই।’
একটু একটু করে বেড়ে ওঠা মায়ের আদুরে সেই ফয়সাল আজকের সাকিব হয়ে উঠে ধারাবাহিক নৈপুণ্যে ক্রিকেট দুনিয়ার আলোচিত ব্যক্তিত্ব। দেশ-বিদেশের ক্রিকেট বিশ্লেষকদের আলোচনায় নিয়মিতই উঠে আসে তার নাম। লাল-সবুজদের গৌরবের চরিত্র। ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার আগে নিশ্চিতভাবেই পৌঁছে যাবেন আরো অনেক অজানা শিখরে।
তথ্যসূত্র :
মাগুরা এডুকেশন ডিরেক্টরি
(ডা: আবুল কাশেম শিক্ষা ফাউন্ডেশন-২০০৮)
আবু বাসার আখন্দ
সাংবাদিক, মাছরাঙ্গা টেলিভিশন