
Home উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা / High Ranking officers > হাতেম আলী খান / Hatem Ali Khan (1910-1999) (Chief Engineer, Roads and Highways)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 89650 বার পড়া হয়েছে
হাতেম আলী খান / Hatem Ali Khan (1910-1999) (Chief Engineer, Roads and Highways)
হাতেম আলী খান
Hatem Ali Khan
(The first chief engineer of the Roads and Highways Department)
Home District: Narail

বাংলাদেশের প্রখ্যাত প্রকৌশলী জনাব হাতেম আলী খান ১৯১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নড়াইল জেলার সদর উপজেলার চিত্রা নদীর পারে বরাশূলা গ্রামে (বর্তমানে নড়াইল পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত) প্রখ্যাত প্রকৌশলী হাতেম আলী খান মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতার নাম বায়জিদ খান। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তবে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কম বয়সেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পিতাকে তিনি হারান কিশোর বয়সে।
১৯৪০ সালে জনাব হাতেম আলী খান অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ সৈয়দ নওশের আলীর দ্বিতীয় কন্যা কনিজ ফতেমা মোহসিনাকে বিবাহ করেন। তাঁর মতো তাঁর স্ত্রীও ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মীদের গোপনে ও প্রকাশ্যে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন যে কারণে এই দেশের প্রগতিশীল বাম রাজনৈতিক কর্মীরা তাকে শ্রদ্ধা করেন। তাঁর দুই সন্তান- দুজনেই বাম রাজনীতিবিদ। বড় ছেলে হায়দার আকবর খান রনো বাংলাদেশের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা। ছোট ছেলে হায়দার আনোয়ার খান (জুনো) বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
শিক্ষাজীবন:
তিনি নড়াইল সদরে অবস্থিত হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং নড়াইলের রূপগঞ্জে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেছিলেন। উভয় পরীক্ষাতেই প্রথম বিভাগে। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ক্লাসে সর্বদা প্রথম স্থান অধিকার করতেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন।
কর্মজীবন
প্রকৌশলী হিসেবে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করার পর হাতেম আলী খান আধুনিক ব্রিজ ডিজাইনার জন চেম্বারের তত্ত্বাবধানে বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ

১৯৩৯ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতের অধীনস্থ অবিভক্ত বাংলার পিডব্লিউডি বিভাগে পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। জনাব হাতেম আলী খান বেঙ্গল (বিহার প্রদেশও অন্তর্ভুক্ত ছিল) সিনিয়র সিভিল সার্ভিস অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। কিন্তু সেই বৎসর থেকে বাংলা ও বিহারের জন্য সিনিয়র সিভিল সার্ভিসের জন্য নিযুক্তি বন্ধ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জনাব হাতেম আলী খান চট্টগ্রাম-আরাকান সড়ক জরুরি ভিত্তিতে নির্মাণের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। সারা ভারত ন্যাশনাল হাইওয়ের জন্য ১৯৪৬ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারত সরকার সারা ভারত থেকে যে ২৪ জন প্রকৌশলীকে নির্বাচন করেছিল, হাতেম আলী খান তাদের অন্যতম ছিলেন। হাতেম আলী খানসহ এই ২৪ জন প্রকৌশলী এক বৎসরের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের পহেলা জানুয়ারি তিনি অবিভক্ত ভারতের পিডব্লিউডির বর্ধমান বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের অধীনে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকেন। ১৯৬৩ সালে সড়ক ও জনপথ নামে নতুন একটি বিভাগ তৈরি হলে তিনি ছিলেন তার প্রথম প্রধান প্রকৌশলী (চিফ ইঞ্জিনিয়ার)। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের সড়ক উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রদানের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য সরকার কর্তৃক তিনি ওয়াশিংনটনে প্রেরিত হয়েছিলেন। সরকারি কাজে ও বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং সম্মেলনে যোগদানের জন্য তিনি সরকারি সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, জাপান, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশে গিয়েছিলেন।
চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ব্যুরো অব কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্সে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। চাকরি জীবনে জনাব হাতেম আলী খান অত্যন্ত সৎ অফিসার, প্রতিভাবান প্রকৌশলী ও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন।
চিফ ইঞ্জিনিয়ার থাকা অবস্থাতেই জনাব হাতেম আলী খান ঢাকাস্থ আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (যা এখন বুয়েট হিসেবে পরিচিত) ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে হাইওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের ওপর তিন বৎসর অধ্যাপনা করেছিলেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য হিসেবেও তিনি কাজ করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭২) প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত উপদেষ্টা প্যানেলের (Advisory Panel) সদস্য হিসেবেও তিনি কাজ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম যুগে সড়ক ও জনপথ এবং সড়ক পরিবহনের জন্য পরিবহন পরামর্শক কমিটির (Transport Consultative Committee) সদস্য হিসেবে তিনি দুই বৎসর কাজ করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবেও কাজ করেছিলেন।
অন্যান্য:
জনাব হাতেম আলী খান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সেও সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের জার্নালে তিনি নিয়মিত লিখতেন। বাংলাদেশের সড়ক উন্নয়নের ওপর তিনি একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন ও পাঠ করেছেন। আইইবি’র ঢাকা কেন্দ্রের তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
জনাব হাতেম আলী খান সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন। বিশ্বসাহিত্যে তার ভালো দখল ছিল। রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, নজরুল, শেক্সপিয়রের বহু কাব্য তাঁর মুখস্ত ছিল। পরশুরাম তার প্রিয় লেখক ছিলেন। তাঁর গৃহ পাঠাগারে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের বই ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বইয়ের বিরল সংগ্রহ ছিল।
জনাব হাতেম আলী খান ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তবুদ্ধির মানুষ। তিনি সাম্যবাদী আদর্শেও বিশ্বাসী ছিলেন। একই ভাবাদর্শের রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যাদের তিনি যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়েও সহযোগিতা করতেন।
পরলোক গমন:
১৯৯৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুও পর বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রী এবং বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসায় এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।