
Home দৃষ্টিপাত (Visibility) > হুমকির মুখে কপোতাক্ষ নদ
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86765 বার পড়া হয়েছে
হুমকির মুখে কপোতাক্ষ নদ
সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে ! সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে; সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে শোনে মায়া - মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে ! বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে ? দুগ্ধ-স্রোতোরুপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে। আর কি হে হবে দেখা ? - যত দিন যাবে, প্রজারুপে রাজরুপ সাগরেরে দিতে বারি - রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে বঙ্গজ জনের কানে, সখে, সখা-রীতে নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে লইছে যে তব নাম বঙ্গের সংগীতে। |
দেশের প্রধান নদগুলোর অন্যতম কপোতাক্ষ। বাংলার দুই মহান পুরুষ বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও মহাকবি মাইকেল মধুসুধন দত্ত এ নদের পারেই জন্মেছেন। এখানেই কাটিয়েছেন শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি। এছাড়া প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ মহাভারতের কপিলমুনি, অলিকুল শিরোমনি, হযরত খান জাহান আলী (রহঃ) ও মোঘল সুবাদারদের স্মৃতিও জড়িয়ে রয়েছে এ নদকে ঘিরে।
কপোতাক্ষ, অতীত ঐতিহ্যের হাতছানি :
বাংলাদেশের দুটি নদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- একটি হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, অন্যটি কপোতাক্ষ। দেশের সকল নদ-নদী মরে গেলেও কপোতাক্ষ মরবে না। কেননা, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কপোতাক্ষ নদকে তাঁর কবিতায় বন্দী করে রেখে গেছেন। বাংলা সাহিত্য যত দিন থাকবে, কপোতাক্ষ নদও তত দিন বেঁচে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তার চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। মহাকবি মধুসূদন সাগরদাঁড়িতে বসে যে কপোতাক্ষ নদকে তুলনা করেছিলেন মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে, সেই নদ এখন মৃত্যুমুখে। কয়েক বছর পর হয়তো এর কোন চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কপোতাক্ষের বুকে ফলবে ফসল। পানি শুকিয়ে বের হবে মাটি - নরম পলিমাটি। হয়তো খুব ক্ষীণ একটি রেখার মতো বয়ে চলবে জলের ধারা। কিংবা ঝিকরগাছার কাছে যে দুরবস্থা, সেটাই অগ্রসর হতে হতে এক সময় পৌঁছাবে দক্ষিণের সাগর পর্যন্ত।
কপোতাক্ষ শব্দকে ভাঙ্গলে দাঁড়ায় ‘কপোত’ আর ‘অক্ষ’। কপোত অর্থ কবুতর, আর অক্ষ অর্থ চোখ। সংস্কৃত ভাষায় কপোতাক্ষ মানে কবুতরের চোখ - পিজিয়ন আই। একসময় এ নদের জল ছিল কবুতরের চোখের মতো স্বচ্ছ। স্বচ্ছসলিলা কপোতাক্ষের জলের দিকে তাকালে তার অন্তরটা পর্যন্ত দেখা যেত - যেমনটি দেখা যেত চিত্রার। কিন্তু কালক্রমে কপোতাক্ষ তার সেই বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। যে নদে জলের দেখা মেলাই ভার, সেখানে আর এক স্বচ্ছসলিল রূপ আসবে কোথা থেকে ? যশোরের ঝিকরগাছা পর্যন্ত তো কপোতাক্ষ আগেই মরেছে, এখন বাকিটুকু বেঁচে আছে যেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগীর মতো। ওটুকুও শিগগিরই মরবে বলে অভিজ্ঞদের ধারণা।
এককালের প্রমত্তা কপোতাক্ষ ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরার লবণাক্ত পানি ও পলি বহন করে নিয়ে আসত। ভাটার সময় তলদেশ ও পাড় ভেঙ্গে উপকূলে নিয়ে যেত, আবার তা জোয়ারের সময় উপরের দিকে নিয়ে যেত। এভাবে ২৪ ঘন্টায় ৪ বার দুকুল ছাপিয়ে প্রমত্তের মত সেদিনের কপোতাক্ষের বিচরণ ছিল। এ সময় প্রাকৃতিক রেজিঃ এর কারণে নদীর তলদেশ গভীর থাকত, নাব্যতা বৃদ্ধি পেত। কপোতাক্ষ ভাটির লবনাক্ত পানির সাথে মিষ্টি পানির মিশ্রনে অপূর্ব মিলন ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। কপোতাক্ষের সেই দৃশ্যটা আজ আর তেমন চোখে পড়ে না।
কপোতাক্ষ সংকটের ঐতিহাসিক পটভূমি :
কপোতাক্ষ নদের জন্ম মাথাভাঙ্গা নদীর গর্ভ থেকে। তবে পরে সে আর মাথাভাঙ্গার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখেনি। দর্শনার কাছে ইছামতী নদী দুই ভাগ হয়ে প্রবাহিত হয়েছে - একটি শাখা প্রবাহিত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভৈরব নামে, অন্যটি কোটচাঁদপুরের দক্ষিণ দিকে ভৈরব থেকে বেরিয়ে কপোতাক্ষ নাম ধারণ করেছে। এটিই পরে খুলনার পাইকগাছার কাছে গিয়ে বড় নদী শিবসার সঙ্গে মিশেছে। পাইকগাছায় কপোতাক্ষর সে মিলনস্থলে কিন্তু জলের মাতম, ঢেউ, স্রোত - সবই আছে। সেখানে কপোতাক্ষ দু-তিন’শ মিটার চওড়া। এমনকি কপিলমুনির কাছে কপোতাক্ষ পাড় ভাঙছে। অথচ অন্যত্র তার অর্ধেকও নেই। একসময় কপোতাক্ষ নদের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ২৬০ বর্গ কিলোমিটার। এখন বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, স্রোতশীল অংশ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪৬ কিলোমিটারে। কপোতাক্ষর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার সামান্য চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কাজের কাজ খুব একটা হয়নি।
এক সময় তাহেরপুরের নিকট ভৈরব নদের প্রবাল স্রোত কপোতাক্ষের দিকে ধাবিত হতো। বর্তমান কপোতাক্ষ একটি মৃত নদ। কপোতাক্ষ নদের শোচনীয় অবস্থায় পরিণত হবার প্রধান কারণ হল- অপরিকল্পিত ব্রিজ, কালভার্ট ও সেতু। বিভিন্ন সূত্র মতে, এ নদীর বুকে ৩০টির মত পাকা ব্রিজ যা নির্মাণ করার সময় বাইপাস সড়ক তৈরী করে নদীকে সংকুচিত করা হয়েছিল। কোথাও কোথাও এ নদী সংকোচনের মাত্রা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ। স্রোত দীর্ঘদিন বাধাপ্রাপ্ত হবার কারণে নদ বক্ষে পলি জমতে শুরু করে। এছাড়া পাটা দেওয়া, মৎস ঘের, কাঠ বাঁশের নির্মিত সেতু, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত ক্রস বাঁধের কারণে পলি জমে নদ ভরাট হয়েছে। মূলতঃ কপোতাক্ষের মরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আজ থেকে দুইশত বছর আগে।
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অবস্থান ভাটি অঞ্চলে হওয়ায় অধিকাংশ নদনদীর উর্ধমুখ দেশের বাইরে। কপোতাক্ষের আদি উৎস গঙ্গা। ভারতের মুর্শিদাবাদ জলাঙ্গির নিকট গঙ্গা থেকে মাথাভাঙ্গার উৎপত্তি। মেহেরপুরের পশ্চিম দিয়ে পদ্মার একটি শাখা মাথাভাঙ্গার সাথে মিশেছে। বর্তমান দর্শনা রেল স্টেশনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোন হতে একটি বৃহত্তর বাঁকে নদীর যুক্ত প্রবাহ ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঐ বাঁকের দক্ষিণ-পূর্ব কোন থেকে ভৈরব মাথাভাঙ্গা থেকে বিচ্যুত হয়ে বৃহত্তর যশোর জেলায় প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে চৌগাছার তাহিরপুরে এসে ভৈরব কপোতাক্ষ শাখা ত্যাগ করে। সরকারী রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৭৪ সালে যশোরের তৎকালীন কালেক্টর ভৈরবের নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর পানি প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য চৌগাছার তাহিরপুরে কপোতাক্ষের উৎস মুখে একটি বাঁধ নির্মাণ করেন। পানির স্রোতে পরবর্তী বর্ষা মৌসুমে সে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে কপোতাক্ষের স্রোত সেখান থেকে কমতে থাকে। পরবর্তীতে দর্শনার ‘কেরু এন্ড কোম্পানী’র নিকট বাঁধ দেওয়ায় ভৈরব ও কপোতাক্ষ উভয়ের স্রোত কমতে থাকে।
সেদিনের পাকিস্তানী শাসকেরা পূর্ব বাংলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ঙচঊঘ পদ্ধতির পরিবর্তে ঈঙজউঙঘ পদ্ধতিতে দেওয়া বাঁধ তৈরী করে জোয়ারের পানির সাথে পলিমাটিকে আটকে দিতে শুরু করলো। যে পলি উজানে এবং ভাটি অঞ্চলের বিস্তৃীর্ণ ভূ-ভাগকে উর্বর করতো এবং ভূ-ভাগ উঁচু করতো, সে পলি এখন শুধু নদীতে জমে নদীর তলদেশ উঁচু করছে।
কপোতাক্ষ নদের এই বিপর্যয়ের ঐতিহাসিক কারণ ব্যাখ্যা করেছেন কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন সমন্বয় কমিটির আহবায়ক অনিল বিশ্বাস। তিনি বলেন, ইংরেজ শাসন আমলে কলকাতা থেকে খুলনা রেল সড়ক নির্মাণ করা হয় ১৯৮৮ সালে। এই সময় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীর উপর প্রথম হস্তক্ষেপ করা হয়। বহু সংখ্যক রেল ব্রিজ কালভার্ট অথবা খালনালা বন্ধ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। ১৯৩৬ সালে বুকভরা বাওড় থেকে মুক্তেশ্বরীর পানি প্রত্যাহার করা হয় ঝিকরগাছার কাটাখালি ব্রিজ দিয়ে কপোতাক্ষে। চুড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৩৮ সালে দর্শনায় কপোতাক্ষ-ভৈরব উৎস মুখে নদের বাঁক ভরাট করে কেরু এন্ড কেম্পানির চিনি কল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই থেকে মাথাভাঙ্গার সঙ্গে কপোতাক্ষ-ভৈরব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে ১৯৩৮ সাল থেকে গঙ্গার মিঠাপানির যোগান বন্ধ হয়ে যায়। এখন কপোতাক্ষের নির্ভরতা কেবল বৃষ্টির পানির উপর। ১৯৭১ সালে পর থেকে কপোতাক্ষের উপর রাস্তা বেঁধে নদের আয়তন কমিয়ে ৩০টির মতো সংকীর্ণ ব্রিজ নির্মাণ করায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি নদী কাঠামো প্রয়োজনীয় মিষ্টিপানির যোগান থেকে বঞ্চিত হয়। স্রোতের গতি স্থিমিত হয়ে পড়ে। শুষ্ক মৌসুমে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি দেশের অনেক গভীরে উঠে আসতে থাকে। সেই সঙ্গে আসত সামুদ্রিক লবনাক্ততা এবং পলি। পঞ্চাশের দশকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক লবণাক্ততার কারণে ফসলহানি ঘটতে থাকে। এছাড়া দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ১ হাজার ৫৫৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ২৮২টি সুইচগেট ও পানি নিয়ন্ত্রণ গেট এবং ৩৭টি পোল্ডার নির্মাণ করা হয়। এর ফলে নদীর অভিন্ন অংগ খাল, নালা ও প্লাবন ভূমি থেকে নদী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্লাবন ভূমিতে পলি পড়তে পারেনি। ফলে উচ্চতা বৃদ্ধি এবং প্লাবন ভূমির গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এতে প্লাবন ভূমির উর্বরতা হ্রাস পায়। প্রতি বছর পলি কেবল নদীর বুকে জমতে থাকে। বিলের থেকে নদীর বুক চড়া হয়ে ওঠে।
কপোতাক্ষ নদ দখলের প্রতিযোগিতা :
এককালের স্রোতবহ এই নদটির অস্তিত্ব এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। বর্তমানে নাব্যহীন বন্ধ্যা কপোতাক্ষ নদ শীর্ণ শার্পিলে প্রবাহিত। আর এ সুযোগে ভদ্রলোক নামধারী এক শ্রেণীর ভূমিদস্যুরা কপোতাক্ষের বুকে রাজত্ব শুরু করেছে। তারা নদের জমি দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বিশেষ করে চৌগাছা ও ঝিকরগাছার বিস্তীর্ণ এলাকা ভূমিদস্যুরা জোর করে দখল করে রেখেছে। প্রভাবশালী শ্রেণীর ভূমিদস্যুরা ঝিকরগাছা এলাকায় রীতিমত পাইলিং করে বহুতল বিশিষ্ট অট্টালিকা তৈরী করেছে। তাদের দেখা দেখি অনেকে বাঁশ খুটির মাধ্যমে ঘর করে দখল করে নিয়েছে কপোতাক্ষের বুক। অপর এক শ্রেণীর স্বার্থন্বেষী মহল নদের যে অংশে পানি আছে সেখানে বাঁশের পাটা ও বাঁধ দিয়ে দখল করে মাছের চাষ করছে। অনেকে আবার পুকুর কেটে দখল করেছে নদের জমি। ভূমিদস্যুরা উজানের বিস্তীর্ণ এলাকা অনেক আগেই দখল করেছে। সেসব জমি এখন আবাদি জমিতে পরিণত করে চাষাবাদ অব্যাহত রেখেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতি :
অতীব দুঃখের বিষয় এই যে অববাহিকার জনগণ বারবার দাবি করা সত্ত্বেও উদ্ভুত পরিস্থিতি উত্তরণে এখনও কোনও বাস্তবোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, যা খুবই অমানবিক। বর্তমানে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ তামাশা দেখার ভুমিকা নিয়েছেন। পাউবো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন খননের জন্যে ৩ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা আছে আরও চার কোটি টাকা বরাদ্ধের ব্যবস্থা হলে তারা নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসে খনন করতে পারেন। অর্থাৎ পানিবন্দী মানুষের দুর্দশা এ মুহুর্তে নিরসন হচ্ছে না। বাস্তব অবস্থা হলো পার খাজুরার ভাটিতে ৩/৪ কিলোমিটার নদের মধ্যভাগ ড্রেজিং এর মাধ্যমে পানি সরানোর ব্যবস্থা করলে উজানের পানির চাপে নদের ব্যাপক পরিমান পলি অপসারিত হয়ে যাবে। ফলে সরকারের অর্থের সাশ্রয় হবে।
যশোরের পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ ব্যাপক দুর্নীতি ও বিশেষ স্বার্থে ড্রেজিং-এর বিরোধিতা করছে। উল্লেখ্য যে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নদ খননের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ ব্যাপক দুর্ণীতি ও অনিয়ম করেছে। তাদের ভূমিকাও এলাকার বিপর্যয়কর পরিস্থিতির অন্যতম কারণ।
আন্দোলন সংগ্রামে যশোরবাসী :
মধুকবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের কপোতাক্ষ এখন কাব্য প্রেরণার উৎস নয় বরং জীবনাতঙ্ক। তীরবর্তী মানুষের জন্য সে এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত ২০০৩ সালে দক্ষিণ বঙ্গের সর্বাধিক আলোচিত ও জনগুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল কপোতাক্ষ আন্দোলন। কিন্তু দীর্ঘকালব্যাপী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মরণ সংকট নিয়ে বাণিজ্য করে আসছে। তাইতো কপোতাক্ষ তীরের জনপদের মানুষ আবেদন নিবেদনের পথ পরিহার করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়। গণ উদ্যোগে গঠিত হয় “কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন সমন্বয় কমিটি” এই কমিটির নেতৃত্বের ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরে ২০০৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সরকার চাপের মুখে কপোতাক্ষ নদের ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করতে বাধ্য হয়।
খননের পরে কপোতাক্ষের বর্তমান অবস্থা :
কপোতাক্ষ এক সময়ে প্রবহমান ও বেগবান ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি মৃতপ্রায় একটি নদ। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে একতরফা পানি শোষণনীতির কারণে বাংলাদেশের অনেক নদীর মত কপোতাক্ষের অবস্থাও করুণ আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে নদীর যেটুকু প্রবাহ আছে সেটুকুও বিপন্ন হবার পথে। নদের স্বাভাবিক পানি প্রবাহের পরিবেশ নেই। প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা প্রশাসনের নাকের ডগায় নদের দুইপাশের জমি দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে কপোতাক্ষ নদ ঝিকরগাছা পর্যন্ত ঝোপঝাড় ও আগাছায় পরিপূর্ণ। কপোতাক্ষ এখন তার যৌবন হারিয়েছে। হারিয়েছে তার সেই প্রমত্ততা। এখন শুধু সে ক্ষীনকায় একটি ধারা। বর্তমানে নদের পানিতে এলকোহলের মাত্রা বেড়েছে। এক সময়ে এ নদে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন তা শুধুই ইতিহাস।
কপোতাক্ষ নদের নাব্যতা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও কপোতাক্ষ খননে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন সমন্বয় কমিটির আহবায়ক অনিল বিশ্বাস ও উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, নতুন করে এই বিপর্যয়ের কারণ হলো ড্রেজিং পরবর্তী কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা না করা। প্রতিশ্রুতি ছিল ড্রেজিং শেষে কপোতাক্ষে একটি ছোট ড্রেজার রেখে দেয়া হবে। তা রাখা হয়নি। ড্রেজিং করার সময় তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন কপোতাক্ষ নদের উৎস মুখ চৌগাছার তাহিরপুর থেকে ১৩০ কিলোমিটার পুনঃর্খনন করা হবে। কিন্তু তা হয়নি। পুনঃর্খনন কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ২০০৫ সালে খনন কাজ শেষ বলে ঘোষণা করা হয়। পুনঃর্খনন কাজে বরাদ্দ দেয়া হয় ২৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। প্রশাসনের গাফিলতি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সংসদ, স্থানীয় পর্যায়ের সরকারী দলের হোমরাচোমরা ও ঠিকাদারদের দুর্নীতি-লুটপাটের কারণে কাজ ভাল হয়নি। ২০০১ ও ২০০৩ সালে কপোতাক্ষ নদে ক্রসবাঁধ দেয়া হয়, যা পরে আর অপসারণ করা হয়নি। বিশেষ করে পাজাখোলা বাঁধের বেশিরভাগ নদীগর্ভে থেকে গেছে। ২০০৫ সালে সরসকাটি ব্রিজের পাশে আর একটি ক্রস বাঁধ দিয়েছিল ঠিকাদার। উদ্দেশ্য কাজে ফাঁকি দেয়া। এসব অনিয়ম দুর্নীতি, লুটপাট ও অবহেলার কারণে ভাটির অংশে পুনরায় পলি জমে নদীর বুকে চওড়া হয়ে উজানে ও অববাহিকার জলাবদ্ধতা নতুন করে বর্তমান বিপর্যয়ের কারণ হয়ে হঠেছে। ড্রেজিংয়ের পর ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমের আগে ৪ বছর কপোতাক্ষ অববাহিকায় ভাল ফসল হলেও সে অর্জন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। নতুন করে তাই প্লাবিত হয়েছে কপোতাক্ষ পাড়ের কেশবপুরের সাগরদাড়ি, কমরপুর, শেখপাড়া, চিংড়া, বিষ্ণুপুর, মির্জাপুর্, মেহেরপুর, গোবিন্দপুর, বাঁশবাড়িয়া, ধরমপুর, বিদ্যানন্দনকাটি, নেহালপুর, রাজাকাটি, মহাদেবপুর, বগা, মমিনপুর, বাউসুলা, হিজলডাঙ্গা, ভবানীপুর, তেঘরিয়া, কাবিলপুর, সাতক্ষীরার কুমিরা ইউপির সেনপুর, দাদপুর, গৌরিপুর, বারিপাড়া, নওয়াপাড়া, দাউনিপাড়া, সাপুর, তেঁতুলিয়া, জাতপুর, লক্ষণপুর, মদনপুর, পাচরকি, কালিয়া, মাড়কালিয়া, ইসলামকাটি ইউপির তালা, ভবানীপুর, খরাইলসহ তালা এবং কলারোয়ার বহু গ্রাম।
কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষের জীবনচিত্র :
শাপলা-শামুক বিক্রি করে বর্ষা মৌসুমে কপোতাক্ষ নদের দু’পাড়ের বন্যার্ত মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। কপোতাক্ষ নদের উপচে পড়া পানিতে শত শত পরিবার বেঁচে থাকার জন্য বর্ষার সময় এপথ বেছে নেয়। চারিদিকে থৈ থৈ পানি, কোথাও কাজ নেই। তাই বন্যার সময় কেশবপুর ও কলারোয়া অহ্চলের প্রায় ১০০০ পরিবার শাপলা শামুক কুড়িয়ে এসময় জীবিকা নির্বাহ করে। শাপলা শামুক কুড়িয়ে তাদের দিনে আয় হয় ৭০-৮০ টাকার মত।
কৃষকের প্রতি সরকারের অবিচার :
কৃষকরা ফসল ফলানোর জন্যে সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কৃষি লোন নেয়। কিন্তু আতিরিক্ত জলাবদ্ধতার কারণে ফসল ফলাতে না পারায় তাদের পক্ষে কৃষি লোনও শোধ করা সম্ভব হয় না। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে লাল নোটিশ দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তাদেরকে খাজনা দিতে বাধ্য করা হয়। সামান্য কিছু লোনের বোঝার কারণে আজ কৃষকরা ঘরে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না।
বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা কৃষকদের জন্য যেমন সমস্যা অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে নদী পাড়ের ব্যাপক এলাকা চাষবাদ হতে বঞ্চিত থাকে। শুধু যশোর অঞ্চলেই প্রতি বছর ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ ব্যহত হচ্ছে। মৃতপ্রায় নদীতে মাছ না পেয়ে দুরাবস্থার শিকার হচ্ছে কয়েক হাজার জেলে পরিবার।
পরিবেশ বিপর্যয় :
বর্তমান নদের বিরাট অংশ কচুরীপানায় গ্রাস করেছে। শুষ্ক মৌসুমে ঝিকরগাছা শহরের উপর দিয়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষের এ দৃশ্য চোখে পড়ার মত। ময়লা আবর্জনায় ভরা এ নদে এখন মশক-কুলের বিস্তার ঘটেছে। যা পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। সংস্কারের অভাবে কপোতাক্ষ ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে হাজামজা নদীতে পরিনত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভরাট থাকার কারণে এতদঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট ছাড়াও নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
সুন্দরবনের জৈব বৈচিত্র বিপন্ন :
দুষিত পানি কপোতাক্ষ নদের সাথে মিশে প্রতিনিয়ত নদকে দুষিত হচ্ছে। এই দুষিত পানির কারণে সুন্দরবনের পরিবেশ ও জৈব বৈচিত্র হুমকির সম্মুখীন। নদের তলদেশে মারাত্মক অক্সিজেনের ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ায় মাছ মারা যাওয়াসহ জীব বৈচিত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দেখা যায় এখনো সুন্দরবনের ৬৫ শতাংশ মিঠাপানি বলেশ্বর ও অন্যান্য নদীর থেকে। তাই অবশ্যই কপোতাক্ষ নদ পুনঃর্খনন করতে হবে। না হলে সুন্দরবন বাঁচবে না। পাশাপাশি কপোতাক্ষ পাড়ের যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনার অনেক নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে ফসলের ক্ষতি হবে।
স্কুল কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত :
কেশবপুরের কপোতাক্ষ পাড়ের অধিকাংশ স্কুল কলেজ বর্ষার অধিকাংশ সময় জলাবদ্ধ থাকে। বর্ষার সময় ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে কোন রকম পাঠদান করা হয়। এ সময় কপোতাক্ষ পাড়ের রেজাকাটি, নেহালপুর, মহাদেবপুর, শেখপুরা, সাগরদাঁড়ি, ত্রিমোহিনী, মির্জাপুর, বিষ্ণুপুরসহ ৮-১০টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত থাকে এবং তখন এ সব গ্রামের অধিকাংশ ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট ও স্কুল-কলেজের বারান্দা হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এর মধ্যে রেজাকাটি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাদেবপুর আর. বি. এস মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নেহালপুর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ত্রিমোহিনী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিষ্ণুপুর আনন্দ নিকেতন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ জলাবদ্ধ থাকে। যে কয়টি কক্ষ ব্যবহারের উপযোগী রয়েছে সেই কয়টি কক্ষে ২/৩ শিফটে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। রেজাকাঠি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জাহানারা খাতুন বলেন, “কপোতাক্ষ পাড়ের অধিকাংশ স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম বর্তমানে হুমকির মুখে। কারণ বন্যা এ অঞ্চলে স্থায়ী রূপ নিয়েছে। ৪/৫ বৎসর ধরে বছরের ৬ মাসই স্কুলে পানি জমে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে শহরের স্কুলগুলোর সাথে এ এলাকার স্কুলের ফলাফলের সমন্বয় ঘটবে না বলে তিনি শংকা প্রকাশ করেন।
প্রশংসনীয় উদ্যোগ :
তালা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অলিউল্লাহ সাহেবের নির্দেশে তৃতীয়বারের মত স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে কপোতাক্ষের পলি অপসারন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ বিকেলে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে জরুরী ভিত্তিতে কপোতাক্ষ নদের পলি অপসারণের কার্যক্রম শুরু করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ সময়ে ইউএনও এর সভাপতিত্বে এনজিও পরিচালকগণ, সরকারী কর্মকর্তা, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ সেপ্টম্বর মাগুরা পয়েন্ট থেকে উপরে কুমিরা সারুলিয়া, ধানদিয়া ও নগরঘাটা ইউনিয়ন পরিষদ, ১১ সেপ্টেম্বর ইসলামকাটী, তালা সদর, তেতুলিয়া ও খলিলনগর ইউনিয়ন পরিষদ, ১৩ সেপ্টেম্বর খেশরা, জালালপুর, মাগুরা ও খলিষখালী ইউনিয়ন পরিষদ মাগুরা থেকে তালা এবং মাগুরা পয়েন্টে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পলি অপসারণ কাজ শুরু করে। কপোতাক্ষ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এর উভয় পাড়ের মানুষ ভয়াল জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে। বারবার নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদসমুহ এনজিও’র স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সংকট থেকে উত্তরণের পথ :
১) ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় অনতিবিলম্বে ক্রস বাঁধের সমুদয় মাটি অপসারণ করে ও ভরাটকৃত অংশ ড্রেজিং করে পানি বের হবার পথ করে দিতে হবে।
২) দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় কপোতাক্ষ নদ সংস্কার, অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও কচুরীপানা অপসারণ করতে হবে।
৩) ক্রস বাঁধ নির্মাণ, খনন কাজে অনিয়ম দূর্নীতি ও উদ্ভুত পরিস্থিতির জন্যে দায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কপোতাক্ষকে স্থায়ীভাবে বাঁচাতে হলে তার উৎস মুখ উজানের জলধারার সাথে সংযোগ সৃষ্টি করতে হবে। উৎসমুখ যদি পানির সন্ধান পায় তাহলে সে তার চলার পথ তৈরী করে নিতে সক্ষম হবে। নদ পাবে তার হারানো যৌবন। আর এ জন্য নদগর্ভ থেকে সমস্ত স্থাপত্য ও রাস্তাঘাট অপসারণ করতে হবে এবং মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি থেকে পুরো কপোতাক্ষ ড্রেজিং করতে হবে। এ জন্য ভারত সরকারেরও সদিচ্ছার প্রয়োজন। কপোতাক্ষকে বাঁচানের বিকল্প প্রক্রিয়া হল কুষ্টিয়ার কুমার নদী যেখানে পদ্মার সাথে মিশেছে সেখানে ড্রেজিং করে পদ্মার স্রোত কুমার নদীতে প্রবাহিত করা। কেননা পদ্মার গভীরতা থেকে কুমার নদীর গভীরতা অনেক কম। পরে কুমার নদী থেকে অল্প পরিসরের খাল খনন করে মাথা ভাঙ্গার সাথে কুমারের সংযোগ স্থাপন করতে হবে। তাহলে পদ্মার স্রোত কুমার নদী হয়ে মাথাভাঙ্গার মাঝ দিয়ে কপোতাক্ষ নদে পৌঁছাবে। এভাবে কপোতাক্ষ তার মৃতপ্রায় অবস্থা হতে মুক্তি পেতে পারে।
অন্যদিকে কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষ মনে করেন এই অবস্থা থেকে পরিত্রান পাবার উপায় হলো নতুন করে কপোতাক্ষ পুনঃর্খনন। তবে ঐ খনন অবশ্যই সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হওয়া উচিৎ। কারণ এর আগেও খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদার, পাউবো (পানি উন্নয়ন বোর্ড) এবং ক্ষমতায় থাকা সংশ্লিষ্ট দলের নেতারা ঐ টাকার বেশীরভাগ লুটপাট করেছে। ফলে কাজে আসেনি কোন কিছু। তবে তার আগে অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে নদী প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন। বর্ষাকালে উজানের পানির চাপ থাকতে থাকতে ভাটিতে পলির চড়া কেটে ড্রেনেজের লাইন করে দিতে হবে। উজানে মাথাভাঙ্গা নদীর সঙ্গে সংযোগ করতে হবে কপোতাক্ষের। এখনও সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ মিঠাপানি কপোতাক্ষ প্রবাহ যোগান দেয়। বাকি ৪০ শতাংশ আসে কচা, ভৈরব, বলেশ্বর ও অন্যান্য নদী থেকে। কপোতাক্ষ খনন প্রকৃয়া বাস্তবায়িত করতে হবে, না হলে সুন্দরবন বাঁচবে না। পাশাপাশি কপোতাক্ষ পাড়ের যশোর, সাতক্ষীরা এবং খুলনার অনেক নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে ফসলের ক্ষতি হবে।
কপোতাক্ষ বিপর্যয়ের ফলাফল :
কপোতাক্ষ নদের এই বিপর্যয়ে অববাহিকার যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরার ৬টি উপজেলার ৭/৮ লক্ষ নর নারী, হাজার হাজার একর দোফসলা তিনফসলা জমি-জমা, বহু সংখ্যক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় স্থায়ী জলবদ্ধতার শিকার হয়ে পড়ে। প্রতি বৎসর ২০টির অধিক বাণিজ্য কেন্দ্র, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বর্ষা নামলেই মনিরামপুর থেকে সাতক্ষীরার তালা থানা ও কলারোয়া উপজেলা পর্যন্ত নদী অববাহিকার বিপুল অংশের জনপদ পানির নিচে ডুবে যায়। বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর নদ তীরস্থ অধিবাসীরা ঘর ছেড়ে ডাঙ্গায় আশ্রয় নেয়। এ সময় কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
কবি মাইকেল মধুসূদনের স্মৃতি :
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেখানে এসে নাও ভিড়িয়েছিলেন, এসেছিলেন স্ত্রী-পুত্রসহ সেই ঘাটের কাঠবাদামের গাছটি এখনো তাঁর আগমনের সাক্ষী হয়ে আছে। গাছটি একটু বুড়ো হয়েছে, গায়ে গিঁট জমেছে। শোনা যায়, কবি সাগরদাঁড়িতে এলেও অন্য ধর্ম গ্রহণ করায় নিজ বাড়িতে প্রবেশ করার অনুমতি পাননি। যে কয়েক দিন ছিলেন, এই কাঠবাদাম গাছের নিচে তাঁবু খাটিয়ে ছিলেন। ছোটবেলায় কলকাতা যাওয়ার আগে তিনি এই ঘাটে এসে বসতেন, মুগ্ধ হয়ে কপোতাক্ষর দিকে তাকিয়ে থাকতেন বলেও শোনা যায়। আজ সবই কিংবদন্তি। এই ঘাট থেকে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার পথে কিছুটা দূরে গিয়ে কবি আরেকটি ঘাটে কিছুক্ষণ থেমেছিলেন। এ দেশ থেকে চির বিদায়ের আগে কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে শেষ আলিঙ্গনের জন্য একটু দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে। সে জন্য সে ঘাটটিকে বলা হয় ‘বিদায় ঘাট’। কবির সেই বিদায় ঘাটে বসে ফলকে লেখা ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি দেখে বড়ই আফসোস হলো মনে। কবিতাটিকে মধুকবির স্মৃতিধন্য এ নদকে কি বাঁচানোর কোন রাস্তা নেই !
শেষ কথা :
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ কপোতাক্ষ নদের এ মরণ দশাময় অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, “কপোতাক্ষ নদটি মাত্র ২৫ কিলোমিটার খনন করলে আবার তার হারানো যৌবন ফিরে পাবে এবং সেটা করা হলে যশোর অঞ্চলের রূপ পাল্টে যাবে। নদে প্রান প্রবাহ সৃষ্টি হলে কপোতাক্ষ পাড়ে গড়ে উঠতো বিভিন্ন কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে শিল্প শহর নওয়াপাড়ার কথা উল্লেখ করা যায়। একমাত্র ভৈরব নদই নওয়াপাড়ার রূপকে পাল্টে দিয়েছে। তাই কপোতাক্ষ নদ খনন করে প্রান প্রবাহ সৃষ্টি করলে কপোতাক্ষ পাড় নদীর তীরবর্তী জনপদে আবার নব জাগরণ সৃষ্টি হবে।
তথ্য সংগ্রহ :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
/
দৈনিক প্রথম আলো রিপোর্ট
সহযোগিতা :
জি এম রাজিব হোসেন
সম্পাদনা :
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
শামিউল আমিন (শান্ত)
তাসলিমা জামান (রূপা)
সর্বশেষ আপডেট :
০১.০৪.২০১১