
Home যোদ্ধা-বিদ্রোহী / Fighters-Rebel > চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদ / Chand Mahmud and koresh Mahmud (1570 Probable)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 89659 বার পড়া হয়েছে
চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদ / Chand Mahmud and koresh Mahmud (1570 Probable)
চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদ
Chand Mahmud and koresa Mahmud
Home District: Narail, Kalia
Chand Mahmud and koresa Mahmud
Home District: Narail, Kalia
বাংলায় মুঘল শাসন সমাপ্তি ত্বরান্বিত করে পলাশির যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সহপাঠিত হয় ১৭৫৭ সালে। তবে ১৭৬৫ সালে ইংরেজ কোম্পানি মুঘল সম্রাটের সঙ্গে এক চুক্তি বলে দেওয়ালি লাভ করেন। এর ফলে সারা বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। নানা ধরনের অব্যবস্থার পরে দেশে অরাজকতা ও অপশাসান চালু হয়। দেশে দেখা দেয় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। বাংলা ১১৭৬ সালে এই দূর্ভিক্ষে শুরু হয়। মন্বন্তর ছিলো ১৭৬৯-১৭৭০ সালের। ইতিহাস পাঠে জানার যায়, এই মহাদূর্ভিক্ষে বাংলার একতৃতীয়াংশ লোক মারা যায়। এই দূর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য কোম্পানি সরকার কিংবা নবাব সরকার এগিয়ে আসেনি। দেশে জারি ছিলো দ্বৈত শাসক। অসহায় জনগন আনাহারে মরতে থাকে। সরকার যেমন নির্বিকার ছিলো তেমনি দেশের বড়ো বড়ো জমিদার রাজা মহারাজারা ও বির্ধিকার ছিলেন। প্রতিবাদ হয়েছে সামান্য দুই এক জায়গায়। এই সময়ে বৃহত্তর যশোরের বর্তমান নড়াইল জেলার বেলফুলিয়া পরগনার দুই বিশিষ্ট জোতদার ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বিরুদ্ধে শৌর্য বলে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছিয়াত্তর মন্বন্তর বিদ্রোহী দুইজন সহোদর চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদ।
জন্ম ও কৈশরঃ
চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের চাঁদ পিতা জয়েনউদ্দিন ৭ পুত্র ও ১ বন্যার পিাত। তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তান হলেন চাঁদ মাহমুদ, কোরেশ মাহমুদ ও পরিমান বিবি। ধারনা করা হয়, তাদের অন্য ৫ ভাই ছিলেন বৈমাত্রিক। এরা নোয়াই, পাঁচকড়ি প্রমুখ। চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদ সুবিখ্যাত সাধক ও অঞ্চল বিজেতে ওয়ালি মাহমুদ খাঁ বা ওয়ালি মাহমুদ শাহের প্রপৌত্র। ওয়ালি মাহমুদ শাহের প্রতিষ্ঠিত কেলাই বাড়ী বা কেলাবাড়ি (ঠাকুর ভিটে) থেকে আধুনিক কলাবাড়িয়ার দশানি মোল্যাপাড়ায় অভিবাসিত হন মধ্যম জয়েন উদ্দিনসহ ৪ সহোদর। ধারনা করা হয়, মুঘল আমলের শেষ পর্যায়ে চাঁদ ও কোরেশ মাহমুদ নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার কেলাবাড়ি বা ঠাকুর ভিটেয় ভূমিষ্ঠ হন। সেখানেই তারা বেড়ে উঠেন। এক পর্যায়ে পিতাও চাচা কাকাদের সঙ্গে বর্তমান দশনি মোল্যাপাড়া আসেন।
বাল্য ও শিক্ষা :
চাঁদ ও কোরেশ মাহমুদ আরবি ফার্সি ও কিছু বাংলা লেখাপড়া করেছিলেন। সেযুগে বরিশালের বড় বাড়িয়া ও লক্ষ্ণীপাশায় আরবি, ফার্সি ও বাংলা ভাষা শেখার জন্য মুসলসানদের পরিচালিত দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো। সম্ভবতঃ এখান থেকেই তারা লেখাপড়া শিক্ষা গ্রহণ করেন। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ মাহমুদ দেশীয় অস্ত্র শিক্ষা ও ঘোড়া চালনা শিক্ষা গ্রহণ করেন। দেশীয় সিফ নেীকায় সিপাহি নিয়ে দস্যু তস্কর ও শত্রু পক্ষকে প্রতিহত করার বিদ্যা শিক্ষা গ্রহণ করেন।
কেলাবাড়ি বেলফুলিয়া পরগনার অন্যতম ডিহি ছিল। মুঘোল আমলে এই ডিহিকে তরফ নামে অভিহিত করা হয়। চাঁদ মাহমুদ মোরসি সূত্তে তরফ কেলাসহ নলদি ও সকিমপুর পরগনার কয়েকটি মহালের অধিকারী ছিলেন। একবার মকিমপুর পরগনার পুটিমারিতে কয়েকটি তরফের জমিদার জোতদারেরা একটি মজলিশে মিলিত হন। কিন্ত আসন গ্রহণ নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এই মজলিশে সব মেহমানই দক্ষিণ দিকের কাচারিতে বসতে চায়। আমন্ত্রণকারী শিকদার জমিদারেরা কোন সমাধানে আসতে পারেন নি। কোন জোতদার আসন সমস্যার সমাধান দিতে পারেন নি। এবার দায়িত্ব দেয়া হয় তরফ কেলাবাড়ির দুই সহোদর জোতদার চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের ওপর। তারা সবাইকে জানালেন যেসব মেহমান যে দিক থেকে এসেছেন তারা সে দিকের শামিয়ানার তলে তারা স্থান পাবেন। এই বিচারে তরফ কেলাবাড়ির জোতদার চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদ ও তাদের লোকজন সম্মানিত দক্ষিণ দিকে বসার সুযোগ পেলেন। সেই সাথে যে যেদিক থেকে এসেছিল সেখানেই স্থান নিতে বাধ্য হলেন। আর তারা বুদ্বিমত্তায় হলেন সবার সেরা। সেখান থেকে লোকমুখে চালু হল :
‘পুটিমারী দেবদুন বাঐসোনা কেলাবাড়ী বান্দর,
মানযির মধ্যে চাঁদ-কোরেশ আর সব বান্দর ॥’
ছিয়াত্তর মন্বন্তর বিদ্রোহী :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও মুর্শিবাদের নবাব সরকারের দ্বৈতশাসনের ফলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। দেশে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্দিনে দেশীয় ভূস্বামীরা চালগুদামে রাখতে থাকে। কোম্পানিও বাজার উজার করে নিজেদের কয়াত্বে রাখে। এদিকে প্রজাসাধারণ অনাহারে বুশাসনে ও অবাবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে থাকে। সেকালের বালিগহণ নদী প্রবাহিত হতো বর্তমান কালিয়া উপজেলা শহর হয়ে সোজা পূর্ব দিকে। আরেকটি শাখা ছিল লক্ষীপুর থেকে পূর্ব দিকে। আরেকটি শাখা ছিলো লক্ষ্মীপুর থেকে পূর্ব দিকে। ঐ নদী বর্তমান মির্জাপুর, চালনার উত্তর পার্শ্ব ও বর্তমান লক্ষীপুর (এই অঞ্চলগুলো নলদি পরননার কালিয়া তরফের অন্তর্ভুক্ত) তরফ কলাবাড়ির কালীনগরের উত্তর পার্শ্বে দিয়ে প্রবাহিত হতো। কালীগঙ্গা নদী কিছুটা পূর্ব দিকে সামান্য উত্তরে আবার পূর্ব দিকে গিয়ে এক সময়ে বাঈসোনা বড়ো ঘাটে আরেকটি নদী ধারার সঙ্গে মিশতো। যাহোক এই প্রাচীন নদী পথে চাঁচড়ার জমিদারদের বিশাল বিশাল ৩খানা চালের জাহাজ লুন্ঠিত হয়। চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের নেতৃত্বে এই লুন্ঠন অংশ নিয়েছিলেন বেলফুলিয়া পরগনা ও মকিমপুর পরগনার ক্ষুধাতুর জন সাধারণ। চাঁচড়ার জমিদার চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের নামে যশোরের ‘থানাদার আদালতে অভিযোগ তোলেন। অভিযুক্ত দুই ভাই যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তাদের চাল লুন্ঠনের বিষয়টি স্কিকার করেন। তারা বলেছিলেন, ‘আমরা দুই ভাই এসেছি চাঁচড়া জমিদার সরকারের কাছ থেকে পুরস্কারের আশায়। ঐ চালের সঙ্গের আমাদের ১৬ বস্তা চাউল দিতে হয়েছে প্রজাদের যাতে তারা ভালোভাবে খেতে পারে। আমরা তো জমিদার বাবুর কাছে খাশির দামই চাইব। দুই ভাই জানালেন, চাঁচড়ার জমিদার বাবুদের সুনাম এখন ছড়িয়ে গেছে বেনফুলিয়া নলাদি মকিমপুর পরগনায়। যাহোক, চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের সহজ স্বীকারেক্তিতে ও সাহসিকতায় তারা অভিযোগ থেকে মুক্তি পান। উপরন্ত চাঁচড়ার জমিদার ভ্রাতৃদ্বয়কে নানা ধরনের উপহার সামগ্রী দিয়েছিলেন। চালের নৌকা লুটের ব্যাপারটি চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের বংশধরেরা দীর্ঘদিন গোপনে রেখেছিলেন। আঞ্চলিক ভাবে সবার জানা। এটা কোনো ডাকাতি নয় এটা ছিলো কোম্পানির দুস্কর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এটা নিঃসন্দেহে বীরত্বব্যাপক ব্যাপার।
চাঁদ-কোরেশের জমিদারিঃ
সুলতানি শাসনামলে আজম খাঁ বা বাগের হাটের পির খানজাহানের শাসিত খালিফাতাবাদ সরকারের দুটি পরগনা হোগলাডাঙ্গা, বেলফুলিয়া ও অন্যান্য পরগনায় তার ভাই বলে জ্ঞাত জামদার খাঁ বা জাহান্দার খাঁ বা জাহান্দার শাহের ইজারা জমিদারি ছিলো। তিনি সরকার-ই-লস্কর ছিলেন। জাহান্দারের এক বিখ্যাত পুত্র ওয়ালি মাহমুদ খাঁ বা ওয়ালি মাহমুদ শাহ বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলাও মাগুরা জেলার অধিকর্তা ছিলেন। তিনি বিবাহ করেছিলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারি উপজেলার শিরগ্রামে। নানা জনপদ পেরিয়ে ওয়ালিমাহমুদ শাহ শিবপুরের এক কোনে ২৭ বিঘা জমির ওপর কেলাইবাড়ী বা কেনাবাড়ি নির্মান করে। কেনা শব্দের অর্থ দুর্গ বা ফোর্ট, ‘এই কেনাবাড়ি ঠাকুর ভিটে’ নামে পরিচিত পায়। ঠাকুর শব্দের অর্থ প্রভু, মালিক, দেশীয় রাজা ইত্যাদি। ওয়ালি মাহমুদ শাহ স্থানীয় লোকদের কাছে ‘ঠাকুর’ বা দেশীয় রাজার মর্যাদা পেয়েছিল। শিবপুরের স্থানীয় বাগোলপদবির এক ব্যক্তির কল্যাণে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন। ওয়ালি বাগোল পদবিধারী ব্যক্তির বংশধরেরা তখন সম্মানিত তালুকদার পদবির অধিকারী। সুলতানি আমলের ডিহি কেলাবাড়ি মুঘল আমলের তরফ কলাবাড়ি ইংরেজ আমলে কলাবাড়ি নামে পরিচিত পায়। কেলাবাড়ি ছিল খলিতাফাতাবাদ সরকারের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র যা ‘ঠাকুর ভিটে’ নামে পরিচিত পায়। [ওয়ালি মাহমুদশাহের প্রথমপক্ষের একমাত্রসূত্র নাসির মাহমুদ। দ্বিতীয় পক্ষের বাগোল কন্যার দুই পুত্র কাদের মাহমুদ ও রওশন মাহমুদ। মাহমুদের বিখ্যাত পৌত্র চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশমাহমুদ প্রমুখ। মুঘাল শাসনামলে মানসিংহ বাংলার সুবাদার হয়ে এসেছিল। তিনি সুন্দরবন এলাকার পরগনাগুলোর ইজাদারের ইজারার পরিবর্তন ঘটান। রীতিমত অনেক মুসলিম জমিদার তাদের জমিদারি হারান। তাদেও স্থলে হিন্দুদের জমিদারি দেয়া হয়। এই জমিদারি দেয়ার একটি কারণ ছিল মুসলিম জমিদারেরা কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও তারা দিল্লিতে খাজনা পাঠাতে গড়িমসি করত। আর বিদ্রোহের সূচনা করতো। আযম খাঁ (খামজাহান), জমিদার খাঁ (মাহাতান্দার খাঁ) যেহেতু স্বাধীন সুলতানি শাসকের ঘনিষ্ঠজন ও প্রশাসনে ছিলেন তাই তাদের উত্তরাধিকারেরা পূর্বে জমিদারি হারান। মানসিংহের সময়ে বেলফুলিয়া পরগনা খন্ডবিখন্ড করে অধিকাংশ মহল তার বিশেষ অনুগতদের দেয়া হয়। জায়নউদ্দিন বেলফুলিয়া পরগনার তরফ কেলাবাড়ি সহ হোগনাডাঙ্গার কিছু মহালপেয়ে শান্ত হলেন। তবে চাকরান ও আয়মা সম্পতি দেয়ার ব্যাপারে তিনিও তার দুই পুত্র চাঁদ ও কোরেশ কার্পণ্য করেন নি। যতোটা জানা যায়, জয়েনউদ্দিনের প্রথম পক্ষের দুই পুত্র চাঁদ মাহমুদ, কোরেশ মাহমুদ ও বন্যা পরিজান বিবি ছাড়াও জীবিত অন্য দুই পুত্র নোয়াই, পাঁচবাড়ি ও তাদের বংশবীরদের বিশাল সম্পতি দাম করা হয়। নোয়াইয়ের বংশবীরেরা আজও সেই সম্পতি ভোগ করছেন। নোয়াইয়ের বংশবীর হলেন, তার দুই কন্যা একজনকে মুন্সি বংশীয় পরিচিতদের পূর্ব পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। আরেক জনকে বিয়ে দেয়া হয় শেখ বংশীয়দের সঙ্গে। মুন্সীদের দেয়া হয় ৭ টাবার একটি মহাল (সম্পতি ) ; এরা দীর্ঘদিন বংশপরম্পরায় এমেটদের কর্মচারী ছিলেন। শেখ বংশীয়দের দেয়া হয় ১৪ টার এক মহাল। দুটি পরিবার মোন্যা পরিবারের ‘আরজুর কুটুম’। এরা মোন্যাজমিদারি এস্টেট বিশেষ সম্মানিত ছিলেন। [জয়েনউদ্দিনের ৭ পুত্র ও ১ কন্যার কথা জানা যায়। তবে সব পুত্রের পরিচয় জানা যায়নি। একমাত্র কন্যা পরিজান বিবিকে বিয়ে দেয়া হয় বর্তমান গোপালগঞ্জ থেকে আগত আগর মোহন খাঁর সঙ্গে। পরিজানকে ৩৬০ বিঘার জমিদার করা হয়। এদের প্রাচীন ভিটে কেলাবাড়ির দশানিপাড়ার ‘আবদার ভিটে’ নামে পরিচিত। আগরের এক উত্তর বংশবীর কলাবাড়িয়া পশ্চিমপারের কাবি আবু সাঈদ। এই পরিবারটি বিশেষ আরজুর। এই পরিবারের লোকেরা মসজিদের ইমাম ছিলেন। আরজুর কুটুম ছাড়াও চাঁদ-কোরেশ এস্টেট থেকে যে পরিবারগুলো চাকরান ও আয়মা সম্পত্তি পেয়েছিলো সেগুলো হল :
১. দাইঃ পশ্চিমপারের মালেক দাইয়েরা
২. ধোপাঃ গাছবাড়িয়া গ্রামের রজনী ধোপারা
৩. পারমানিকঃ গিরীশ ও তার পূর্ব পুরুষেরা
৪. খালামিঃ ছয়ানিপাড়ায় বসবাসকারী গাছিয়া
৫. জেলেঃ দশানিপাড়ার মামি সম্প্রদায়
স্থানীয় লোকছড়ার মধ্য দিয়ে জমিদার চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের গুনগান শোনা যায় :
‘কেলাবাড়ি তরফ-ডিহি
তাই আজোউজোন দেহি
সাতাইশ গেরাম তরফ খান
মোল্যা দিগের জানের জান।
আরো আছে মোল্যার চক
কোচাওড়ার তাইতে ঢক,
ধনে জনে শক্তিমান চান কোরেশ মহায়ান
এরা বড়ো জমিদার
রাস্তাচলা বা খবরদার।’
চাঁদ ও কোরেশ মাহমুদ কালিগঙ্গার যে এলাকায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে চালের নৌকা লুট করেছিলেন তার নাম ‘চাঁদেরদহ’ লোক মুখে তা ‘চাঁন্দের দোয়া’ ও ‘চানবোর বিল’ নামে পরিচিত। চান্দের দোয়ার পশ্চিম সীমান্ত বর্তমান লক্ষ্মীপুর গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম দিকের জলাশয় (হিন্দুরা এখানে ধর্মীয় উৎসব করে থাকে)। চাঁদের দহের পূর্বাংশ এখন কলাবাড়িয়ার দশনিমোল্যা পাড়ার উত্তরাংশে অবস্থিত। দুই অংশের দূরত্ব আড়াআড়ি প্রায় দুই মাইল। প্রায় ২শত বছর আগে এটা ছিলো কালিগঙ্গা নদীর অখন্ড স্রোতম্বিনী এই পরিবারের আরেকটি সম্পদ, হলো কলাবাড়িয়া গ্রামের দক্ষিণ-পূর্বাশের মোল্যারচক’ বা ‘মোল্যারচল’। ৩০০ বিঘা জমির বিশালচকটি মোল্যাদের সম্পত্তি। মূল জমিদারির সমস্ত সম্পতি প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করা হয় চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের মধ্যে। কোরেশ মাহমুদের দুই পুত্র সুরাতউল্লাহ ও জকিমাহমুদ সুরাতউল্লাহর অকাল মৃত্যুতে মোল্যা পরিবারের অর্ধেক সম্পতি ও জোত জমার অধিকারী হন জকি মাহমুদ। জকি মাহমুদ পৃথক এটেস্টেও অধিকারী হন। জকি মাহমুদের অংশে বড়ো তরফ বলে পরিগমিত করা হয়। চাঁদ মাহমুদের অর্ধেক সম্পতি ও জোত কুমার অধিকারী হন। এই ৮ আনা সম্পতিকে আবার ১৬ আনা ধরে তার পুত্রদের মধ্যে নিম্নোক্ত পর্যায়ে ভাগ করা হয়। এই বংশের প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ কলাবাড়ি ইউনিয়ন কাউন্সিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল মান্নান মিয়া জানিয়ে ছিলেন, চাঁদ মাহমুদের একাত্বিক স্ত্রীর সন্তানদের মধ্যে সম্পতি ভাগ হয়েছে তাদের পৈত্রিক কেীলিন্য অনুসারে। বিভাজনটি নিম্নরুপ :
১. বক্তার মুন্সী - ৪ আনা
২. রওশন মোল্যাহ - ৪ আনা
৩. গোলাম হোসেন মুন্সী - আড়াই আনা
৪. কালে মাহমুদ - আড়াই আনা
৫. গনেশ মোল্যাহ - দেড় আনা
৬. দলিলউদ্দিনের পিতা - দেড় আনা
শেষমেশ মোল্যাহ প্রাচীন জমিদার পরিবারটিকে ৩টি তরফে বিভাজন করা হয়। জকি মাহমুদের অংশ বড়ো তরফ, বক্তার মুন্সি ও রশম মোল্যার অংশ মধ্যম তরফ বাকি ৪ জনের অংশ ছোট তরফ নামে পরিচিত পায়। ২৭ টি গ্রামের সমন্বয়ে যে তরফ কেলাবাড়ি ছিলো তার আরেকটি পরিচয় ছিলো তরফ কেলাবাড়ি বা তরফ কলাবাড়ি। কেলাবাড়ি বা কলাবাড়ি এই প্রাচীন পরিবারটি দামধামে ছিলো প্রচন্ড উৎসাহী। একবার বক্তার মুন্সীর কোনো পুত্র গ্রামের মূলখানার মধ্য দিয়ে পথ চলার সময় বেদম শিকদারের দাদা তার মেয়েকে (বিয়ের সময়ে) কিছু দিতে না পারায় জমিদার ঘোড়ার পিঠে তাকে ৫ বিঘা জমিদান করেন। বেদনের উত্তরাধিকারীরা সেই সম্পতি আজো ভোগ করছে। কোরেশ মাহমুদের পুত্র জকি মাহমুদ তার এটেস্টের দেওয়ার কবুল রাঙা শেখের পিতামহকে ৯ বিঘা জমিদান করেন । এই ভূমিসত্ত ঐ পরিবারের লোকেরা আজও ভোগ করছেন। জবি মাহমুদ তার কনিষ্ঠ শ্বশুর পক্ষের লোকদের মল্লিকদের ও ভূমিদান করেছিলেন। চাঁদ ও কোরেশ মাহমুদের ভাইপো সম্পর্কে ওয়ারেস মাহমুদের পরিবার যশোরের সুপ্রাচীন কাংফুল জনপদের শক্তিশালী ‘মিনা’ গোষ্ঠীর একজনকে ‘আরজুর কুটুম’ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাদেরও ভূমির সত্তবান করেন। এই সব পরিবার প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত। চাঁদ ও কোরেশ মাহমুদের বীজী পুরুষ ছিলেন সরবর-ই-লস্কর, পরবর্তীকালে এরা মিয়া, মুন্সী ও মোল্যা পদবিতে পরিচিত হয়ে আসছেন। চাঁদ মাহমুদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন, বক্তার মুন্সী, আফাজউদ্দিন মুন্সি, তোফাজউদ্দিন মুন্সী, দবিরউদ্দিন ওরফে দুদু মিয়া, নড়াইল টাউন কমিটির প্রথমে প্রেসিডেন্ট রাজনীতিবিদ আসাদুজ্জামান, ঢাকা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ও মানিকগঞ্জের সাবেক জেনাঃ গভর্নর এম. নুরুজ্জামান, একাত্তরের থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মনিরুজ্জামান বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার, ফেরদাউস আহমেদ মোল্যা প্রমুখ। কোরেশ মাহমুদের অন্যতম উত্তরাধিকারী হলেন, নীলবিদ্রোহী জকি মাহমুদ, গগন মিয়া, সত্তর দশকের অন্যতম কবি মহসিন হোসেন প্রমুখ।
সম্পাদনা:
মহসিন হোসাইন
যে সমস্ত গ্রন্থের তথ্য নেয়া হয়েছে :
১. নড়াইলের ইতিহাস - মুহঃ মনতাজুর রহমান ও শরিফ আঃ হাকিম সম্পাদিত
২. কালিয়া উপজেলা পরিশ্রমা - মহসিন হোসাইন
৩. নড়াইল জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য - মহসিন হোসাইন
৪. বাগেরহাটের খানজাহান ও তার উত্তরাধিকার - মোঃ রফিকুল হক আযাদ
৫. মোহম্মদপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সালাউদ্দিন আহমদ মিল্টন
(সালাউদ্দিন আহমদ মিল্টন)
জন্ম ও কৈশরঃ
চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের চাঁদ পিতা জয়েনউদ্দিন ৭ পুত্র ও ১ বন্যার পিাত। তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তান হলেন চাঁদ মাহমুদ, কোরেশ মাহমুদ ও পরিমান বিবি। ধারনা করা হয়, তাদের অন্য ৫ ভাই ছিলেন বৈমাত্রিক। এরা নোয়াই, পাঁচকড়ি প্রমুখ। চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদ সুবিখ্যাত সাধক ও অঞ্চল বিজেতে ওয়ালি মাহমুদ খাঁ বা ওয়ালি মাহমুদ শাহের প্রপৌত্র। ওয়ালি মাহমুদ শাহের প্রতিষ্ঠিত কেলাই বাড়ী বা কেলাবাড়ি (ঠাকুর ভিটে) থেকে আধুনিক কলাবাড়িয়ার দশানি মোল্যাপাড়ায় অভিবাসিত হন মধ্যম জয়েন উদ্দিনসহ ৪ সহোদর। ধারনা করা হয়, মুঘল আমলের শেষ পর্যায়ে চাঁদ ও কোরেশ মাহমুদ নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার কেলাবাড়ি বা ঠাকুর ভিটেয় ভূমিষ্ঠ হন। সেখানেই তারা বেড়ে উঠেন। এক পর্যায়ে পিতাও চাচা কাকাদের সঙ্গে বর্তমান দশনি মোল্যাপাড়া আসেন।
বাল্য ও শিক্ষা :
চাঁদ ও কোরেশ মাহমুদ আরবি ফার্সি ও কিছু বাংলা লেখাপড়া করেছিলেন। সেযুগে বরিশালের বড় বাড়িয়া ও লক্ষ্ণীপাশায় আরবি, ফার্সি ও বাংলা ভাষা শেখার জন্য মুসলসানদের পরিচালিত দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো। সম্ভবতঃ এখান থেকেই তারা লেখাপড়া শিক্ষা গ্রহণ করেন। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ মাহমুদ দেশীয় অস্ত্র শিক্ষা ও ঘোড়া চালনা শিক্ষা গ্রহণ করেন। দেশীয় সিফ নেীকায় সিপাহি নিয়ে দস্যু তস্কর ও শত্রু পক্ষকে প্রতিহত করার বিদ্যা শিক্ষা গ্রহণ করেন।
কেলাবাড়ি বেলফুলিয়া পরগনার অন্যতম ডিহি ছিল। মুঘোল আমলে এই ডিহিকে তরফ নামে অভিহিত করা হয়। চাঁদ মাহমুদ মোরসি সূত্তে তরফ কেলাসহ নলদি ও সকিমপুর পরগনার কয়েকটি মহালের অধিকারী ছিলেন। একবার মকিমপুর পরগনার পুটিমারিতে কয়েকটি তরফের জমিদার জোতদারেরা একটি মজলিশে মিলিত হন। কিন্ত আসন গ্রহণ নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এই মজলিশে সব মেহমানই দক্ষিণ দিকের কাচারিতে বসতে চায়। আমন্ত্রণকারী শিকদার জমিদারেরা কোন সমাধানে আসতে পারেন নি। কোন জোতদার আসন সমস্যার সমাধান দিতে পারেন নি। এবার দায়িত্ব দেয়া হয় তরফ কেলাবাড়ির দুই সহোদর জোতদার চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের ওপর। তারা সবাইকে জানালেন যেসব মেহমান যে দিক থেকে এসেছেন তারা সে দিকের শামিয়ানার তলে তারা স্থান পাবেন। এই বিচারে তরফ কেলাবাড়ির জোতদার চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদ ও তাদের লোকজন সম্মানিত দক্ষিণ দিকে বসার সুযোগ পেলেন। সেই সাথে যে যেদিক থেকে এসেছিল সেখানেই স্থান নিতে বাধ্য হলেন। আর তারা বুদ্বিমত্তায় হলেন সবার সেরা। সেখান থেকে লোকমুখে চালু হল :
‘পুটিমারী দেবদুন বাঐসোনা কেলাবাড়ী বান্দর,
মানযির মধ্যে চাঁদ-কোরেশ আর সব বান্দর ॥’
ছিয়াত্তর মন্বন্তর বিদ্রোহী :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও মুর্শিবাদের নবাব সরকারের দ্বৈতশাসনের ফলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। দেশে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্দিনে দেশীয় ভূস্বামীরা চালগুদামে রাখতে থাকে। কোম্পানিও বাজার উজার করে নিজেদের কয়াত্বে রাখে। এদিকে প্রজাসাধারণ অনাহারে বুশাসনে ও অবাবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে থাকে। সেকালের বালিগহণ নদী প্রবাহিত হতো বর্তমান কালিয়া উপজেলা শহর হয়ে সোজা পূর্ব দিকে। আরেকটি শাখা ছিল লক্ষীপুর থেকে পূর্ব দিকে। আরেকটি শাখা ছিলো লক্ষ্মীপুর থেকে পূর্ব দিকে। ঐ নদী বর্তমান মির্জাপুর, চালনার উত্তর পার্শ্ব ও বর্তমান লক্ষীপুর (এই অঞ্চলগুলো নলদি পরননার কালিয়া তরফের অন্তর্ভুক্ত) তরফ কলাবাড়ির কালীনগরের উত্তর পার্শ্বে দিয়ে প্রবাহিত হতো। কালীগঙ্গা নদী কিছুটা পূর্ব দিকে সামান্য উত্তরে আবার পূর্ব দিকে গিয়ে এক সময়ে বাঈসোনা বড়ো ঘাটে আরেকটি নদী ধারার সঙ্গে মিশতো। যাহোক এই প্রাচীন নদী পথে চাঁচড়ার জমিদারদের বিশাল বিশাল ৩খানা চালের জাহাজ লুন্ঠিত হয়। চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের নেতৃত্বে এই লুন্ঠন অংশ নিয়েছিলেন বেলফুলিয়া পরগনা ও মকিমপুর পরগনার ক্ষুধাতুর জন সাধারণ। চাঁচড়ার জমিদার চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের নামে যশোরের ‘থানাদার আদালতে অভিযোগ তোলেন। অভিযুক্ত দুই ভাই যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তাদের চাল লুন্ঠনের বিষয়টি স্কিকার করেন। তারা বলেছিলেন, ‘আমরা দুই ভাই এসেছি চাঁচড়া জমিদার সরকারের কাছ থেকে পুরস্কারের আশায়। ঐ চালের সঙ্গের আমাদের ১৬ বস্তা চাউল দিতে হয়েছে প্রজাদের যাতে তারা ভালোভাবে খেতে পারে। আমরা তো জমিদার বাবুর কাছে খাশির দামই চাইব। দুই ভাই জানালেন, চাঁচড়ার জমিদার বাবুদের সুনাম এখন ছড়িয়ে গেছে বেনফুলিয়া নলাদি মকিমপুর পরগনায়। যাহোক, চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের সহজ স্বীকারেক্তিতে ও সাহসিকতায় তারা অভিযোগ থেকে মুক্তি পান। উপরন্ত চাঁচড়ার জমিদার ভ্রাতৃদ্বয়কে নানা ধরনের উপহার সামগ্রী দিয়েছিলেন। চালের নৌকা লুটের ব্যাপারটি চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের বংশধরেরা দীর্ঘদিন গোপনে রেখেছিলেন। আঞ্চলিক ভাবে সবার জানা। এটা কোনো ডাকাতি নয় এটা ছিলো কোম্পানির দুস্কর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এটা নিঃসন্দেহে বীরত্বব্যাপক ব্যাপার।
চাঁদ-কোরেশের জমিদারিঃ
সুলতানি শাসনামলে আজম খাঁ বা বাগের হাটের পির খানজাহানের শাসিত খালিফাতাবাদ সরকারের দুটি পরগনা হোগলাডাঙ্গা, বেলফুলিয়া ও অন্যান্য পরগনায় তার ভাই বলে জ্ঞাত জামদার খাঁ বা জাহান্দার খাঁ বা জাহান্দার শাহের ইজারা জমিদারি ছিলো। তিনি সরকার-ই-লস্কর ছিলেন। জাহান্দারের এক বিখ্যাত পুত্র ওয়ালি মাহমুদ খাঁ বা ওয়ালি মাহমুদ শাহ বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলাও মাগুরা জেলার অধিকর্তা ছিলেন। তিনি বিবাহ করেছিলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারি উপজেলার শিরগ্রামে। নানা জনপদ পেরিয়ে ওয়ালিমাহমুদ শাহ শিবপুরের এক কোনে ২৭ বিঘা জমির ওপর কেলাইবাড়ী বা কেনাবাড়ি নির্মান করে। কেনা শব্দের অর্থ দুর্গ বা ফোর্ট, ‘এই কেনাবাড়ি ঠাকুর ভিটে’ নামে পরিচিত পায়। ঠাকুর শব্দের অর্থ প্রভু, মালিক, দেশীয় রাজা ইত্যাদি। ওয়ালি মাহমুদ শাহ স্থানীয় লোকদের কাছে ‘ঠাকুর’ বা দেশীয় রাজার মর্যাদা পেয়েছিল। শিবপুরের স্থানীয় বাগোলপদবির এক ব্যক্তির কল্যাণে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন। ওয়ালি বাগোল পদবিধারী ব্যক্তির বংশধরেরা তখন সম্মানিত তালুকদার পদবির অধিকারী। সুলতানি আমলের ডিহি কেলাবাড়ি মুঘল আমলের তরফ কলাবাড়ি ইংরেজ আমলে কলাবাড়ি নামে পরিচিত পায়। কেলাবাড়ি ছিল খলিতাফাতাবাদ সরকারের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র যা ‘ঠাকুর ভিটে’ নামে পরিচিত পায়। [ওয়ালি মাহমুদশাহের প্রথমপক্ষের একমাত্রসূত্র নাসির মাহমুদ। দ্বিতীয় পক্ষের বাগোল কন্যার দুই পুত্র কাদের মাহমুদ ও রওশন মাহমুদ। মাহমুদের বিখ্যাত পৌত্র চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশমাহমুদ প্রমুখ। মুঘাল শাসনামলে মানসিংহ বাংলার সুবাদার হয়ে এসেছিল। তিনি সুন্দরবন এলাকার পরগনাগুলোর ইজাদারের ইজারার পরিবর্তন ঘটান। রীতিমত অনেক মুসলিম জমিদার তাদের জমিদারি হারান। তাদেও স্থলে হিন্দুদের জমিদারি দেয়া হয়। এই জমিদারি দেয়ার একটি কারণ ছিল মুসলিম জমিদারেরা কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও তারা দিল্লিতে খাজনা পাঠাতে গড়িমসি করত। আর বিদ্রোহের সূচনা করতো। আযম খাঁ (খামজাহান), জমিদার খাঁ (মাহাতান্দার খাঁ) যেহেতু স্বাধীন সুলতানি শাসকের ঘনিষ্ঠজন ও প্রশাসনে ছিলেন তাই তাদের উত্তরাধিকারেরা পূর্বে জমিদারি হারান। মানসিংহের সময়ে বেলফুলিয়া পরগনা খন্ডবিখন্ড করে অধিকাংশ মহল তার বিশেষ অনুগতদের দেয়া হয়। জায়নউদ্দিন বেলফুলিয়া পরগনার তরফ কেলাবাড়ি সহ হোগনাডাঙ্গার কিছু মহালপেয়ে শান্ত হলেন। তবে চাকরান ও আয়মা সম্পতি দেয়ার ব্যাপারে তিনিও তার দুই পুত্র চাঁদ ও কোরেশ কার্পণ্য করেন নি। যতোটা জানা যায়, জয়েনউদ্দিনের প্রথম পক্ষের দুই পুত্র চাঁদ মাহমুদ, কোরেশ মাহমুদ ও বন্যা পরিজান বিবি ছাড়াও জীবিত অন্য দুই পুত্র নোয়াই, পাঁচবাড়ি ও তাদের বংশবীরদের বিশাল সম্পতি দাম করা হয়। নোয়াইয়ের বংশবীরেরা আজও সেই সম্পতি ভোগ করছেন। নোয়াইয়ের বংশবীর হলেন, তার দুই কন্যা একজনকে মুন্সি বংশীয় পরিচিতদের পূর্ব পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। আরেক জনকে বিয়ে দেয়া হয় শেখ বংশীয়দের সঙ্গে। মুন্সীদের দেয়া হয় ৭ টাবার একটি মহাল (সম্পতি ) ; এরা দীর্ঘদিন বংশপরম্পরায় এমেটদের কর্মচারী ছিলেন। শেখ বংশীয়দের দেয়া হয় ১৪ টার এক মহাল। দুটি পরিবার মোন্যা পরিবারের ‘আরজুর কুটুম’। এরা মোন্যাজমিদারি এস্টেট বিশেষ সম্মানিত ছিলেন। [জয়েনউদ্দিনের ৭ পুত্র ও ১ কন্যার কথা জানা যায়। তবে সব পুত্রের পরিচয় জানা যায়নি। একমাত্র কন্যা পরিজান বিবিকে বিয়ে দেয়া হয় বর্তমান গোপালগঞ্জ থেকে আগত আগর মোহন খাঁর সঙ্গে। পরিজানকে ৩৬০ বিঘার জমিদার করা হয়। এদের প্রাচীন ভিটে কেলাবাড়ির দশানিপাড়ার ‘আবদার ভিটে’ নামে পরিচিত। আগরের এক উত্তর বংশবীর কলাবাড়িয়া পশ্চিমপারের কাবি আবু সাঈদ। এই পরিবারটি বিশেষ আরজুর। এই পরিবারের লোকেরা মসজিদের ইমাম ছিলেন। আরজুর কুটুম ছাড়াও চাঁদ-কোরেশ এস্টেট থেকে যে পরিবারগুলো চাকরান ও আয়মা সম্পত্তি পেয়েছিলো সেগুলো হল :
১. দাইঃ পশ্চিমপারের মালেক দাইয়েরা
২. ধোপাঃ গাছবাড়িয়া গ্রামের রজনী ধোপারা
৩. পারমানিকঃ গিরীশ ও তার পূর্ব পুরুষেরা
৪. খালামিঃ ছয়ানিপাড়ায় বসবাসকারী গাছিয়া
৫. জেলেঃ দশানিপাড়ার মামি সম্প্রদায়
স্থানীয় লোকছড়ার মধ্য দিয়ে জমিদার চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের গুনগান শোনা যায় :
‘কেলাবাড়ি তরফ-ডিহি
তাই আজোউজোন দেহি
সাতাইশ গেরাম তরফ খান
মোল্যা দিগের জানের জান।
আরো আছে মোল্যার চক
কোচাওড়ার তাইতে ঢক,
ধনে জনে শক্তিমান চান কোরেশ মহায়ান
এরা বড়ো জমিদার
রাস্তাচলা বা খবরদার।’
চাঁদ ও কোরেশ মাহমুদ কালিগঙ্গার যে এলাকায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে চালের নৌকা লুট করেছিলেন তার নাম ‘চাঁদেরদহ’ লোক মুখে তা ‘চাঁন্দের দোয়া’ ও ‘চানবোর বিল’ নামে পরিচিত। চান্দের দোয়ার পশ্চিম সীমান্ত বর্তমান লক্ষ্মীপুর গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম দিকের জলাশয় (হিন্দুরা এখানে ধর্মীয় উৎসব করে থাকে)। চাঁদের দহের পূর্বাংশ এখন কলাবাড়িয়ার দশনিমোল্যা পাড়ার উত্তরাংশে অবস্থিত। দুই অংশের দূরত্ব আড়াআড়ি প্রায় দুই মাইল। প্রায় ২শত বছর আগে এটা ছিলো কালিগঙ্গা নদীর অখন্ড স্রোতম্বিনী এই পরিবারের আরেকটি সম্পদ, হলো কলাবাড়িয়া গ্রামের দক্ষিণ-পূর্বাশের মোল্যারচক’ বা ‘মোল্যারচল’। ৩০০ বিঘা জমির বিশালচকটি মোল্যাদের সম্পত্তি। মূল জমিদারির সমস্ত সম্পতি প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করা হয় চাঁদ মাহমুদ ও কোরেশ মাহমুদের মধ্যে। কোরেশ মাহমুদের দুই পুত্র সুরাতউল্লাহ ও জকিমাহমুদ সুরাতউল্লাহর অকাল মৃত্যুতে মোল্যা পরিবারের অর্ধেক সম্পতি ও জোত জমার অধিকারী হন জকি মাহমুদ। জকি মাহমুদ পৃথক এটেস্টেও অধিকারী হন। জকি মাহমুদের অংশে বড়ো তরফ বলে পরিগমিত করা হয়। চাঁদ মাহমুদের অর্ধেক সম্পতি ও জোত কুমার অধিকারী হন। এই ৮ আনা সম্পতিকে আবার ১৬ আনা ধরে তার পুত্রদের মধ্যে নিম্নোক্ত পর্যায়ে ভাগ করা হয়। এই বংশের প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ কলাবাড়ি ইউনিয়ন কাউন্সিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল মান্নান মিয়া জানিয়ে ছিলেন, চাঁদ মাহমুদের একাত্বিক স্ত্রীর সন্তানদের মধ্যে সম্পতি ভাগ হয়েছে তাদের পৈত্রিক কেীলিন্য অনুসারে। বিভাজনটি নিম্নরুপ :
১. বক্তার মুন্সী - ৪ আনা
২. রওশন মোল্যাহ - ৪ আনা
৩. গোলাম হোসেন মুন্সী - আড়াই আনা
৪. কালে মাহমুদ - আড়াই আনা
৫. গনেশ মোল্যাহ - দেড় আনা
৬. দলিলউদ্দিনের পিতা - দেড় আনা
শেষমেশ মোল্যাহ প্রাচীন জমিদার পরিবারটিকে ৩টি তরফে বিভাজন করা হয়। জকি মাহমুদের অংশ বড়ো তরফ, বক্তার মুন্সি ও রশম মোল্যার অংশ মধ্যম তরফ বাকি ৪ জনের অংশ ছোট তরফ নামে পরিচিত পায়। ২৭ টি গ্রামের সমন্বয়ে যে তরফ কেলাবাড়ি ছিলো তার আরেকটি পরিচয় ছিলো তরফ কেলাবাড়ি বা তরফ কলাবাড়ি। কেলাবাড়ি বা কলাবাড়ি এই প্রাচীন পরিবারটি দামধামে ছিলো প্রচন্ড উৎসাহী। একবার বক্তার মুন্সীর কোনো পুত্র গ্রামের মূলখানার মধ্য দিয়ে পথ চলার সময় বেদম শিকদারের দাদা তার মেয়েকে (বিয়ের সময়ে) কিছু দিতে না পারায় জমিদার ঘোড়ার পিঠে তাকে ৫ বিঘা জমিদান করেন। বেদনের উত্তরাধিকারীরা সেই সম্পতি আজো ভোগ করছে। কোরেশ মাহমুদের পুত্র জকি মাহমুদ তার এটেস্টের দেওয়ার কবুল রাঙা শেখের পিতামহকে ৯ বিঘা জমিদান করেন । এই ভূমিসত্ত ঐ পরিবারের লোকেরা আজও ভোগ করছেন। জবি মাহমুদ তার কনিষ্ঠ শ্বশুর পক্ষের লোকদের মল্লিকদের ও ভূমিদান করেছিলেন। চাঁদ ও কোরেশ মাহমুদের ভাইপো সম্পর্কে ওয়ারেস মাহমুদের পরিবার যশোরের সুপ্রাচীন কাংফুল জনপদের শক্তিশালী ‘মিনা’ গোষ্ঠীর একজনকে ‘আরজুর কুটুম’ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাদেরও ভূমির সত্তবান করেন। এই সব পরিবার প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত। চাঁদ ও কোরেশ মাহমুদের বীজী পুরুষ ছিলেন সরবর-ই-লস্কর, পরবর্তীকালে এরা মিয়া, মুন্সী ও মোল্যা পদবিতে পরিচিত হয়ে আসছেন। চাঁদ মাহমুদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন, বক্তার মুন্সী, আফাজউদ্দিন মুন্সি, তোফাজউদ্দিন মুন্সী, দবিরউদ্দিন ওরফে দুদু মিয়া, নড়াইল টাউন কমিটির প্রথমে প্রেসিডেন্ট রাজনীতিবিদ আসাদুজ্জামান, ঢাকা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ও মানিকগঞ্জের সাবেক জেনাঃ গভর্নর এম. নুরুজ্জামান, একাত্তরের থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মনিরুজ্জামান বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার, ফেরদাউস আহমেদ মোল্যা প্রমুখ। কোরেশ মাহমুদের অন্যতম উত্তরাধিকারী হলেন, নীলবিদ্রোহী জকি মাহমুদ, গগন মিয়া, সত্তর দশকের অন্যতম কবি মহসিন হোসেন প্রমুখ।
সম্পাদনা:
মহসিন হোসাইন
যে সমস্ত গ্রন্থের তথ্য নেয়া হয়েছে :
১. নড়াইলের ইতিহাস - মুহঃ মনতাজুর রহমান ও শরিফ আঃ হাকিম সম্পাদিত
২. কালিয়া উপজেলা পরিশ্রমা - মহসিন হোসাইন
৩. নড়াইল জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য - মহসিন হোসাইন
৪. বাগেরহাটের খানজাহান ও তার উত্তরাধিকার - মোঃ রফিকুল হক আযাদ
৫. মোহম্মদপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সালাউদ্দিন আহমদ মিল্টন
(সালাউদ্দিন আহমদ মিল্টন)