
Home শিল্পী / Artist > উদয় শঙ্কর / Uday Shankar (1900-1972)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86693 বার পড়া হয়েছে
উদয় শঙ্কর / Uday Shankar (1900-1972)
উদয় শঙ্কর
Uday Shankar
Kalia, Narail
Uday Shankar
Kalia, Narail
পারিবারিক পরিচিতি :

উদয় শঙ্কর প্রাচ্য নৃত্যকলার ক্ষেত্রে একাই একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর বিশ্ব বিজয় এবং বিশ্বকে এই উপমহাদেশীয় শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত

এই বিশ্ব নন্দিত নৃত্য শিল্পী ১৯০০ খৃষ্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর ভারতের রাজস্থানের উদয়পুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শ্যামশঙ্কর চৌধুরী সেখানকার রাজার দেওয়ান এবং বিখ্যাত আইনজীবি ছিলেন। উদয়পুরে জন্ম হওয়ায় বাবা শ্রী শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী তাঁর নাম রাখলেন উদয়। উদয়ের স্নেহময়ী মাতার নাম হেমাঙ্গিনী। তাঁর অপর তিন ভাই হলেন রাজেন্দ্র শঙ্কর, দেবেন্দ্র শঙ্কর ও রবি শঙ্কর। রবিশঙ্কর তাঁর ভাইয়ের ন্যায় সংগীতে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেতার বাদক। শঙ্কর পরিবারের উত্থান যে উদয় শঙ্করকে ঘিরে, তাঁর পৈতৃক বসতভিটা বৃহত্তর যশোরের নড়াইলের কালিয়াতে।
উদয় শঙ্কর, অমলা শঙ্কর, রবিশঙ্কর হয়ে আনন্দ শঙ্কর-মমতা শঙ্কর পর্যন্ত এক ঝাঁক উজ্জ্বলতম নাম যশোরের গৌরব গাঁথায় রত্নখচিত আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। যদিও উদয় শঙ্কর বা রবিশঙ্করের স্মৃতিতে যশোর হয়তো বহু পূর্বেই বিস্মৃত এবং কখনোই যশোরের মাটির স্পর্শ তাঁদের শরীর, মন ও মনন গঠনে কোন অবদান রাখেনি, তবুও শেকড়কে অস্বীকার করা যায় না বলেই যশোরের কৃতি সন্তান হিসেবে তাঁরা অবিস্মরণীয়।

উদয় শঙ্কর ১৯৪২ সালে মাগুরার মেয়ে প্রখ্যাত নৃত্য শিল্পী অমলা শঙ্করের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। শ্রীমতি অমলা শঙ্করের একমাত্র কন্যা মমতা শঙ্করও একজন নামকরা অভিনেত্রী ও আন্তজার্তিক খ্যাতি সম্পন্ন নৃত্য শিল্পী। মমতা শঙ্কর সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনসহ অনেক খ্যাতিমান পরিচালকের পরিচালিত ছায়াছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে যশোরাধিকারিণী হয়েছেন। তিনি বর্তমানে কোলকাতায় মমতা শঙ্কর ব্যালে ট্রুপস -এর কার্যক্রমসহ কয়েকটি নৃত্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতীয় নৃত্য প্রশিক্ষণ ও প্রচারে নিয়োজিত রয়েছেন।
অমলা শঙ্করের একমাত্র পুত্র আনন্দ শঙ্কর সংগীত জগতে এক আন্তজার্তিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর সেতারের সুর বিশ্বনন্দিত। তিনি বেশ কয়েকটি ছায়াছবিতে সুর সংযোজন ও সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে প্রখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেনের ‘কোরাস’ ছবিতে সুরারোপের জন্যে তিনি পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। তাঁর স্ত্রী তনুশ্রী শঙ্করও একজন নামকরা নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী।

শিক্ষাজীবন :
উদয় শঙ্করের প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয় বারানসীতে। পরবর্তীতে বোম্বাইতে জেঃ জেঃ স্কুল অব আর্টস এ চিত্র কলাসহ শিল্প সংস্কৃতির বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তারপর লন্ডন রয়্যাল কলেজ অব আর্টস এ চিত্রশিল্পে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্যে গমন করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় ছাত্র যিনি সেখানে ‘সেন্সর’ ও ‘জর্জক্লাঝেন’ নামে দুটি পদক লাভের কৃতিত্ব অর্জন করেন।
সংগ্রামীজীবন :
উদয়ের বাবার ছিল বিশাল অর্থ প্রতিপত্তি। বাল্যকালে পিতার জীবনাবসান ঘ্টলে তাঁকে অর্থ কষ্টে পড়তে হয়েছিল। অর্থ সংগ্রহের জন্য জীবন সংগ্রামে নামতে হয়। বাবার মৃত্যুর পর মা আর ছোট তিন ভাই এর দেখাশুনার দায়িত্ব তাঁর উপর বর্তায়।
শিল্পীজীবন :
নৃত্যশিল্পী হিসেবে উদয় শঙ্করের প্রথম আবির্ভাব ঘটে লন্ডনে থাকাকালীন ভারতীয় নৃত্য রচনার মাধ্যমে। এ সময় এই নৃত্যগুলি সেখানকার প্রদর্শনীতে মঞ্চায়ন করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। লন্ডনের আইভি হাউসে নৃত্য প্রদর্শনের সময় প্রখ্যাত রাশিয়ান ব্যালেরিনা আনাপাভলোভা তাঁর মনোমুগ্ধকর নৃত্য দেখে মোহিত হন।
আনাপাভলোভা প্রাচ্য নৃত্যকলার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং প্রাচ্য ওরিয়েন্টাল নৃত্য প্রশিক্ষণ দেবার জন্যে উদয় শঙ্করকে তাঁর দলে নিয়োগ করেন। তাঁরই অনুরোধে ১৯২৩ সালে উদয় শঙ্কর ‘রাধাকৃষ্ণ’ ও ‘হিন্দু বিবাহ’ নামে দুটি ভারতীয় নৃত্য রচনা করেন। এ নৃত্য দুটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় লন্ডনের কভেন্ট গার্ডেনের রয়েল অপেরা হাউসে। উদয়

দীর্ঘদিন পাভলোভার সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নৃত্য প্রদর্শনের পর তিনি স্বতন্ত্রভাবে দল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রচন্ড প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। বিশেষ করে আনাপাভলোভার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তাঁর মনে জন্ম ছিল এক নতুন উদ্যম। সিমকী ছিলেন নৃত্য সঙ্গিনী আর আর্থিক সাহায্য দাতা ছিলেন বিত্তশালিনী চিত্রশিল্পী শ্রীমতি অ্যালিস বোনার।
উদয় শঙ্কর ভারতবর্ষে ফিরে এসে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে শাস্ত্রীয় ও লোক নৃত্য সংগ্রহ করেন। কেরালার গুরাভাযুরের একটি মন্দিরে নৃত্য অনুষ্ঠানে ‘কথাকলি’ নৃত্য দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। এই নৃত্য শেখা এবং একে গভীরভাবে জানার জন্যে কথাকলি নৃত্য গুরু শঙ্করণ নামবুদ্রীকে শিক্ষাগুরু হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে উদয় শঙ্কর অ্যালিস বোনারের সহযোগিতায় তাঁর সাংস্কৃতিক দল নিয়ে প্যারি

এই দলের সংগীত পরিচালক ছিলেন তিমির বরণ। উদয় শঙ্করের প্রধান নৃত্য সঙ্গিনী ছিলেন সিমকী। আরো অনেকের মধ্যে এই দলে ছিলেন রবি শঙ্কর ও তাঁদের সহযোগিনী মাতা হেমাঙ্গিনী। উদয় শঙ্কর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলেছিলেন ‘গন্ধর্বনৃত্য’, ‘সাপুড়েনৃত্য’, ‘রাধাকৃষ্ণনৃত্য, ‘তলোয়ারনৃত্য’ এবং ব্যালে হিসেবে ‘শিবপার্বতী’, ‘লেবার এ্যান্ড মেশিনারী’, ‘রিদম অব লাইফ’ প্রভৃতি নৃত্য।
১৯৩১ সালের ৩ মার্চ প্যারিসে এই নৃত্য দলের সাড়া জাগানো অনুষ্ঠান থেকেই উদয় শঙ্করের জয়যাত্রার শুরু। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একের পর এক জয় করেছেন পাশ্চাত্যের মঞ্চগুলো আর তাঁদের হৃদয়।
১৯৩৩ সালে ইউরোপ আমেরিকায় নৃত্যকলা প্রদর্শন করে জয়মাল্য গলায় নিয়ে দেশে ফিরলেন উদয় শঙ্কর। কোলকাতার টাউন হলে তাঁকে দেওয়া হলো

১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে উদয় শঙ্কর আলমোড়ায় পাহাড়ের উপত্যকা জুড়ে ভারত বিখ্যাত ওস্তাদ শঙ্করণ নামবুদ্রীক, কন্দপ্পন পিল্লেই, আমোবি সিংহ ও আলাউদ্দীন খাঁ-কে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘উদয় শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’। কিন্তু দুঃখের বিষয় ১৯৪৪ সালে এই সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
সংগীত বিষয়ে উদয় শঙ্কর ছিলেন এক ধরণের পথ প্রদর্শক। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন বিভিন্ন ধরণের বাদ্যযন্ত্র।
এগুলির সমন্বয়ে একটা নিজস্ব শব্দ ঝংকার সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। তাঁর ব্যবহৃত প্রতিটি বাদ্যযন্ত্রই ছিল ভারতীয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাঁশি, সেতার, একতারা, তানপুরা এস্রাজ, সরোদ, খঞ্জনি, ঢোল ও ড্রাম। তিনি তাঁর দলে কখনোই বিদেশী যন্ত্র ব্যবহার করেননি।
তাঁর অসংখ্য সৃষ্টির একটা দিক হচ্ছে শ্যাডো প্লে । সেখানে তিনি সাদা পর্দার ওপর নিজস্ব কৌশলে নতুন আলো ছায়ার ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর শিল্পীজীবনের একটা বিরাট স্থান দখল করে আছে ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্র। ছবিটি আর্থিক সাফল্য না পেলেও এটি তাঁর এক কালজয়ী সৃষ্টি।
১৯৬৫ সালে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘উদয় শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচার সেন্টার’। নতুন উদ্যমে দলকে সুসংগঠিত করে ১৯৬৮ সালে আবার তিনি বেরিয়ে পড়লেন আমেরিকা সফরে। এটিই তাঁর জীবনে শেষ বারের মত আমেরিকা সফর।

১৯৭০ সালে রঞ্জিতমল কাংকারিয়ার সহযোগিতায় প্রযোজনা করেছিলেন ‘শঙ্করস্কোপ’। ১৯৭২ সালে ‘শঙ্করস্কোপ’ ও ‘সামান্য ক্ষতি’ নৃত্য নাট্যের নবরূপায়নই ছিল তাঁর জীবনের শেষ কীর্তি। বৃদ্ধ বয়সে আরও কিছু সৃষ্টিধর্মী নৃত্য রচনার বাসনায় টালিগঞ্জের রাধা ফিল্মের ফ্লোর ভাড়া নিয়ে তিনি নৃত্যের মহড়া চালিয়ে যেতেন।
সম্মাননা :
এই বিশ্ববরেণ্য নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্যে বিশ্ববাসীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন অভাবনীয় স্বীকৃতি ও সম্মান। বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রভারতী তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ এবং ‘ডি লিট’ উপাধি ও ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি প্রদান করেন।
পরলোক গমন :
১৯৭২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর কালছায়া চির দিনের মত তাঁর এ সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে দেয়।
তথ্য সূত্র :
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট :
ফেব্রুয়ারী ২০১২ ইং
ইউনুচ আলী