
Home ধর্ম-সাধক / Religion-saint > মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরেুল্লাহ / Munsi Mohammad Meherullah (1861-1907)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 89658 বার পড়া হয়েছে
মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরেুল্লাহ / Munsi Mohammad Meherullah (1861-1907)
ভাব মন দমে দম, রাহা দূর বেলা কম
ভুখ বেশী অতি কম খানা।
ছামনে দেখিতে পাই পানি তোর তরে নাই
কিন্তু রে পিয়াসা ষোল আনা !
দেখিয়া পরের বাড়ী জামা জোড়া ঘোড়া গাড়ি
ঘড়ি ঘড়ি কত সাধ মনে,
ভুলেছ কালের তালি, ভুলেছ বাঁশের চালি,
ভুলিয়াছ কবর সামনে।
ভুখ বেশী অতি কম খানা।
ছামনে দেখিতে পাই পানি তোর তরে নাই
কিন্তু রে পিয়াসা ষোল আনা !
দেখিয়া পরের বাড়ী জামা জোড়া ঘোড়া গাড়ি
ঘড়ি ঘড়ি কত সাধ মনে,
ভুলেছ কালের তালি, ভুলেছ বাঁশের চালি,
ভুলিয়াছ কবর সামনে।
পরি
চিতি:
কবিতাটিতে মানবদেহের পরিণাম এবং সংসারের ধন-জন ও বংশ মর্যাদা কিভাবে কবরে বিলীন হয়ে যায়, কবি এই ভাবার্থটি প্রস্ফূটিত করে তুলেছেন।
এই কবিতাটির রচয়িতা-আধ্যাত্নিক চিন্তা চেতনার সাধক, বঙ্গের খ্যাতিমান বাগ্মী, সমাজসেবক, সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক ও ধর্ম প্রচারক মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর ১৮৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর জেলার ঝিনাইদহ মহাকুমার কালীগঞ্জ থানাধীন বার বাজারের নিকটবর্তী ঘোপ নামক গ্রামে নিজ মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছাতিয়ানতলা গ্রামে। এই গ্রামে তাঁর পূর্ব পুরুষরাই সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্শী মোহাম্মদ ওয়ারেস উদ্দীন।
শিক্ষাজীবন:
সংসারের নিদারুন দরিদ্রতা ও পিতার অকাল মৃত্যুর কারণে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিঘ্নিত হয়। এ সময় তিনি নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করে দুর্দ্দমনীয় জ্ঞান তৃষ্ণার তাড়নায় গৃহত্যাগ করে কয়ালখালি গ্রাম নিবাসী মোঃ মোস্হাব উদ্দীনের নিকট তিন বৎসর এবং পরবর্তীতে করচিয়া নিবাসী মোহাম্মদ ইসমাইলের নিকট তিন বৎসর আরবী ও ফারসী ভাষা শিক্ষা করেন। বিশ্ব বরেণ্য কবি শেখ সাদীর পান্দেনামা, গুলিস্থা ও বুস্তা তাঁর জীবনের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তৎকালীন সময়ে উক্ত ২টি পুস্তকের ওপর জ্ঞান ও হৃদয়ঙ্গমতা কোন ব্যক্তির জ্ঞান ও শিক্ষার মাপ কাঠি বিবেচিত হত। তিনি বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তৃতার মধ্যে এই সমস্ত গ্রন্থ থেকে অতি মধুর সুরে ফরাসী বয়াত আবৃত্তি করে মর্মষ্পর্শী ভাষায় শ্রোতাকুলকে আপ্লুত করতেন।
উর্দু ভাষায় ও তাঁর ব্যাপক ব্যুৎপত্তি ছিল। বিভিন্ন উর্দু পুস্তক ও সাময়িক পত্র পত্রিকাদি তিনি নিয়মিত পড়াশোনা করতেন।
জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি জীবিকার অন্বেষণে তিনি খোজার হাটের এক দর্জির দোকানে সেলাইয়ের কাজ শেখা শুরু করেন। এ সময়ও তিনি মুন্শী তাজ মাহমুদের নিকট উর্দু ও ফারসী সাহিত্যের উপর জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন।
মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ দর্জি বিদ্যায় উন্নত শিক্ষা গ্রহণের জন্যে খড়কী গ্রামের ‘সাহেব বাড়ীর দর্জি’ জাহা বকস্ মীর্জার নিকট দর্জির কাজ শেখা আরম্ভ করেন। এখানে তিনি দীর্ঘ ৫/৬ বৎসর অবস্থান করে দর্জি পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। এই ভিন্নধর্মী কাজের মাঝেও তিনি জ্ঞান অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। যশোর শহরের দড়াটানায়ও তিনি এক উন্নত মানের দর্জির দোকান চালু করেন।
ইসলাম ধর্মের প্রচারক:
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্য বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এদেশের মুসলমানদেরও ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। বাংলাদেশের সমস্ত গ্রাম-গঞ্জ শহর বাজারের খ্রীস্টান পাদ্রীদের খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারের প্রবল প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পায়। পাদ্রীদের নানা কুহেলিকাপূর্ণ কূট তর্কজাল সমাচ্ছন্ন বক্তৃতা শুনতে শুনতে অল্প বয়স্ক সত্যানুসন্ধিৎসু মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ বিচলিত হয়ে পড়েন। এরূপ এক সংকটকালীন মুহূর্তে প্রসিদ্ধ বক্তা ও ইসলাম প্রচারক হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ কর্তৃক লিখিত ‘খ্রীস্টান ধর্মের ভ্রষ্টতা’ নামক এবং প্রথম জীবনে খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারক ও পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম প্রচারক পাদ্রী ঈশান চন্দ্র মন্ডল ওরফে মুন্শী মোহাম্মদ এহসানুল্লাহর ‘ইনজিলে হয়রত মোহাম্মদের খবর আছে’ গ্রন্থ দু’খানি অধ্যয়নের পর তিনি নতুন আলোর সন্ধান পান।
ইসলামের নতুন তেজে নতুন শক্তিতে পূর্ণ হয়ে দীপ্ত মিহিরের ন্যায় নিত্য পরিপূর্ণ ও প্রতিভাত হতে লাগলেন। মুসলিম বীর মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ পাদ্রীদের অনুকরণে হাটে মাঠে ঘাটে তাঁদের বক্তৃতার তীব্র প্রতিবাদ শুরু করলেন। হাটের একদিকে পাদ্রীদের বক্তৃতা অন্য প্রান্তে মুন্শীর বক্তৃতা। অতি অল্প সময়ে তরুণ মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর ধর্ম প্রচারের ঘটনা গ্রামে, শহরে এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
মুন্শী সুদূর দার্জিলিং শহরেও দর্জির দোকান খুলেছিলেন এবং সেখানেও পাদ্রীদের একই অনাচার ও কার্যকলাপ দেখে তাঁর মন প্রাণ ব্যাকুল ও ব্যথিত হয়ে উঠলো। তিনি সেখানেও ধর্ম প্রচারের কাজ আরম্ভ করেন। ধর্ম-জ্ঞানে পরিপূর্ণতা লাভের জন্যে তিনি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন শুরু করেন। মুন্শী মেহেরুল্লাহ মহীশুর থেকে প্রকাশিত ‘মনসুরে মোহাম্মদী’ এবং হয়রত সোলায়মান ওয়ার্সির লেখা কেন আমি আমার পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করেছিলাম’, ‘কেন আমি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হয়েছিলাম’ ও ‘প্রকৃত সত্য কোথায়’ গ্রন্থগুলি পাঠ করে ব্যাপক উৎসাহিত ও উপকৃত হয়েছিলেন।
মেহেরুল্লাহ দার্জিলিং থেকে যশোরে ফিরে এসে আবার যশোরের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ম প্রচারের কাজে আত্ননিয়োগ করেন। এসময় তাঁর সহযোগী হিসেবে খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে ধর্ম প্রচারে অবতীর্ণ হতেন যশোরের ঘোপ এলাকার বাসিন্দা মুন্শী গোলাম রব্বানী ও ঘুরুলিয়ার মুন্শী মোহাম্মদ আব্দুল কাশেম।
মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ইসলাম ধর্ম প্রচারের এবং খ্রীস্টানদের মিথ্যা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জেহাদ ঘোষণা করেন এবং জেহাদকে সার্থক ও সফল করার লক্ষ্যে তিনি কলকাতার মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা মুন্শী রিয়াজ উদ্দিন আহাম্মদ ও মুন্শী আব্দুর রহিম প্রমুখ ধর্মপ্রাণ, মুসলিম হিতৈষী নেতাদের সাথে আলোচনা করেন। মুসলিম সমপ্রদায়ের কল্যাণ ও খ্রীস্টান পাদ্রিদের অপপ্রচারের হাত থেকে ইসলাম ধর্ম তথা মুসলিম সমাজকে রক্ষা করার অভিপ্রায়ে কলকাতার ‘না-খোদা’ মসজিদে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতি নামে এক সমিতি গঠন করা হয়। এই সমিতি কর্তৃক বাংলা ও আসামে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্যে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি বঙ্গ ও আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্দীপ্তময় যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলমানদের ভাঙ্গা বুক আবার সতেজ করে তোলেন।
খ্রীস্টান ধর্ম প্রচার মিশনের অন্যতম কর্তা রেভাঃ জন জমিরুদ্দিন ইসলাম ধর্ম প্রচারে এক সময় মুন্শী মেহেরুল্লাহর সঙ্গী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মুন্শী মেহেরুল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইসলাম ধর্মের ব্যাপক বিরোধিতা করেন।
সাহিত্য কর্ম:
১৮৯২ সালে জুন মাসে ‘খ্রীস্টীয় বান্ধব’ নামক মাসিক পত্রিকায় জন জমিরুদ্দিন ‘আসল কোরান কোথায়’ শীর্ষক এক বিভ্রান্তিমূলক প্রবন্ধ লেখেন। এই বিভ্রান্তিকর প্রবন্ধের জবাবে মুন্শী মেহেরুল্লাহ তৎকালীন প্রচলিত বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ পত্রিকায় (১৮৯২ সালের জুন মাসের ২০ ও ২৭ তারিখে) ‘ঈসায়ী বা খ্রীস্টানী ধোকা ভঞ্জন’ নামক সুদীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করে জন জমিরুদ্দিন কর্তৃক লিখিত ছয়টি প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ উত্তর প্রদান করেন। মেহেরুল্লাহর প্রবন্ধের উত্তরে জমিরুদ্দিন ‘সুধাকর’ পত্রিকাতেই ক্ষুদ্র আরেকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এর উত্তরে মুন্শী মেহেরুল্লাহ ‘আসল কোরান সর্বত্র’ নামক আর একটি দীর্ঘ ও তথ্য যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
জন জমিরুদ্দিন প্রবন্ধটি পড়ে নীরব হয়ে পড়েন। মুন্শী মেহেরুল্লাহর সহযোগী হবার আশা ব্যক্ত করে খ্রীস্টান হতে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জন জমিরুদ্দিন হতে শেখ মুন্শী জমিরুদ্দিন নাম ধারণ করেন।
খ্যাতিমান ইসলাম প্রচারক মুন্শী মেহেরুল্লাহর ধর্ম প্রচারের ইতিহাসে এটি এক বিষ্কয়কর ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। জমিরুদ্দিন কর্তৃক লিখিত ‘মেহের চরিত’ নামক গ্রন্থে তিনি মুন্শী মেহেরুল্লাহর ধর্ম প্রচার সম্পর্কে উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেছেন।
মুসলিম জাতির উন্নয়নে সাহিত্য ও সংবাদ পত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির জন্যে অক্লান্ত প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন।
এ উদ্দ্যেশে তিনি চব্বিশ পরগণা নিবাসী শেখ আব্দুল রহিমের সাথে যোগাযোগ করেন। তখনকার দিনে মুন্শী আবদুর রহিমের সম্পাদনায় ও মুন্শী শেখ রিয়াজউদ্দীনের প্রকাশনায় কলকাতা থেকে মুসলিম ঐতিহ্যবাহী ‘সুধাকার’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। ‘মিহির’ ও ‘সুধাকার’ পত্রিকা দুটির উন্নতি ও প্রচারের জন্যে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর বিশেষভাবে প্রচেষ্টা চালান। ‘মিহির’ ও ‘সুধাকার’ নামক মাসিক পত্রিকারও তিনি পৃষ্ঠপোষকতা ও এই পত্রিকাগুলির নিয়মিত লেখক ছিলেন।
বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্যে ও জাতীয়তা গঠনের মূলে এই মনীষীসহ শেখ ফজলুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মৌলভী রেয়াজুদ্দিন আহাম্মদ, কবি মোজাম্মেল হক ও সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী’র নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য।
১৮৮৬ খৃঃ মুন্শী মেহেরুল্লাহ প্রথম প্রকাশিত বই ‘খ্রীস্ট ধর্মের অসারতা’ প্রকাশিত হয়। এই বইটি খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারকদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ও খ্রীস্টান ধর্মগ্রন্থ বাইবেল সম্পের্কে সমালোচনা করে লেখা।
তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘মেহেরুল এসলাম’। গ্রন্থখানির ভাষা অত্যন্ত সহজ সরল, সাধারণ পাঠকের বোঝার উপযোগ্য। গ্রন্থটি পুঁথি আকারে লিখিত। এই গ্রন্থে একেশ্বরবাদের মাহাত্ন্য প্রচারিত হয়েছে।
বিখ্যাত পারস্য কবি শেখ সাদির পান্দেনামা পুস্তকটি অনুবাদ করে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ লিখিত ‘রদ্দে খ্রীস্টান’ এবং ‘খ্রীস্টান ধর্মের অসারতা’ নামক পুস্তক দু’খানি তাঁর বক্তৃতা অপেক্ষা অনেক কার্য উপযোগী। এই পুস্তক দু’খানি যেন সারা দেশ ব্যাপি খ্রীস্টান পাদ্রীদের মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ‘রদ্দে খ্রীস্টান’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ড ‘দলিলুল ইসলাম’ প্রকাশের পূর্বেই মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ইন্তেকাল করেন।
মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা আর্জন করেছিল ‘বিধায় গঞ্জনা’ ও ‘হিন্দু ধর্ম রহস্য’। হিন্দু বিধবাদের জীবনের করুণ চিত্র মর্মষ্পর্শী ভাষায় সমালোচনাকারে গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণে ‘বিধবা গঞ্জনা’ গ্রন্থটি মুন্শী মেহেরুল্লাহর এক অপূর্ব সাহিত্য সৃষ্টি।
“দেবলীলা বা হিন্দু ধর্ম রহস্য’ নামক গ্রন্থটিতে পৌরাণিক দেবদেবীগণের লীলা খেলার কাহিনী নিয়ে রচিত। গ্রন্থটির ভিত্তি হচ্ছে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র। গ্রন্থ দু’খানিতে হিন্দু সমাজের সংকীর্ণতা ও বিধবাদের মনঃপীড়ার করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
মুন্শী মেহেরুল্লাহর মৃত্যুর পর কতিপয় স্বার্থান্বেষী হিন্দু সমাজপতির প্রচেষ্টায় ইংরেজ সরকার উক্ত পুস্তক দু’খানি বাজেয়াপ্ত করে এবং প্রকাশকের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
পরলোক গমন:
বঙ্গের অদ্বিতীয় বাগ্মী, ইসলাম ধর্ম প্রচারক মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ১৯০৭ সালের ৭ জুন শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় পরলোকগমন করেন।
মুন্সি মেহেরুল্লাহ স্মরণে :
এই কর্মবীর মুন্সি মেহেরুল্লাহর মুত্যুর পর তাঁর নিজ গ্রাম ছাতিয়ানতলায় তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্টেশন প্রতিষ্ঠা করে তার নামক
রণ করা হয় ‘মেহেরুল্লাহনগর স্টেশন’।
অসাধারণ বাগ্নী, সমাজসংস্কারক, ইসলাম প্রচারক মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ এর ১৯৯৫ সালের ৭ জুন ৮৭ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম তাঁর স্মৃতিকে আগামী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে মুন্শী মেহেরুল্লাহ এর ছবিসহ ডাকটিকিট ও স্মারক খামের উদ্বোধন করেন।
১৯০১ সালে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ কর্তৃক যশোরের মনোহরপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় মাদ্রাসায়ে কেরামতিয়া। পরবর্তীতে তাঁর প্রচেষ্টায় মাদ্রাসাটি এম. ই স্কুলে রূপান্তরিত হয়ে আজকের পর্যায়ে উন্নীত হয়। এলাকাবাসী ও কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের উপাধ্যক্ষ মশিউল আযমের প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়টি এই কর্মবীরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নামকরণ করা হয় মুন্শী মেহেরুল্লাহ একাডেমী। পরে তাদের প্রচেষ্টায় মুন্শী মেহেরুল্লাহ সমাজকল্যাণ সংস্থা ও মুন্শী মেহেরুল্লাহ ফাউন্ডেশন গড়ে উঠে।
তথ্য সূত্র :
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ আপডেট :
মার্চ ২০১২

কবিতাটিতে মানবদেহের পরিণাম এবং সংসারের ধন-জন ও বংশ মর্যাদা কিভাবে কবরে বিলীন হয়ে যায়, কবি এই ভাবার্থটি প্রস্ফূটিত করে তুলেছেন।
এই কবিতাটির রচয়িতা-আধ্যাত্নিক চিন্তা চেতনার সাধক, বঙ্গের খ্যাতিমান বাগ্মী, সমাজসেবক, সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক ও ধর্ম প্রচারক মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর ১৮৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর জেলার ঝিনাইদহ মহাকুমার কালীগঞ্জ থানাধীন বার বাজারের নিকটবর্তী ঘোপ নামক গ্রামে নিজ মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছাতিয়ানতলা গ্রামে। এই গ্রামে তাঁর পূর্ব পুরুষরাই সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্শী মোহাম্মদ ওয়ারেস উদ্দীন।
শিক্ষাজীবন:
সংসারের নিদারুন দরিদ্রতা ও পিতার অকাল মৃত্যুর কারণে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিঘ্নিত হয়। এ সময় তিনি নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করে দুর্দ্দমনীয় জ্ঞান তৃষ্ণার তাড়নায় গৃহত্যাগ করে কয়ালখালি গ্রাম নিবাসী মোঃ মোস্হাব উদ্দীনের নিকট তিন বৎসর এবং পরবর্তীতে করচিয়া নিবাসী মোহাম্মদ ইসমাইলের নিকট তিন বৎসর আরবী ও ফারসী ভাষা শিক্ষা করেন। বিশ্ব বরেণ্য কবি শেখ সাদীর পান্দেনামা, গুলিস্থা ও বুস্তা তাঁর জীবনের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তৎকালীন সময়ে উক্ত ২টি পুস্তকের ওপর জ্ঞান ও হৃদয়ঙ্গমতা কোন ব্যক্তির জ্ঞান ও শিক্ষার মাপ কাঠি বিবেচিত হত। তিনি বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তৃতার মধ্যে এই সমস্ত গ্রন্থ থেকে অতি মধুর সুরে ফরাসী বয়াত আবৃত্তি করে মর্মষ্পর্শী ভাষায় শ্রোতাকুলকে আপ্লুত করতেন।
উর্দু ভাষায় ও তাঁর ব্যাপক ব্যুৎপত্তি ছিল। বিভিন্ন উর্দু পুস্তক ও সাময়িক পত্র পত্রিকাদি তিনি নিয়মিত পড়াশোনা করতেন।
জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি জীবিকার অন্বেষণে তিনি খোজার হাটের এক দর্জির দোকানে সেলাইয়ের কাজ শেখা শুরু করেন। এ সময়ও তিনি মুন্শী তাজ মাহমুদের নিকট উর্দু ও ফারসী সাহিত্যের উপর জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন।
মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ দর্জি বিদ্যায় উন্নত শিক্ষা গ্রহণের জন্যে খড়কী গ্রামের ‘সাহেব বাড়ীর দর্জি’ জাহা বকস্ মীর্জার নিকট দর্জির কাজ শেখা আরম্ভ করেন। এখানে তিনি দীর্ঘ ৫/৬ বৎসর অবস্থান করে দর্জি পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। এই ভিন্নধর্মী কাজের মাঝেও তিনি জ্ঞান অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। যশোর শহরের দড়াটানায়ও তিনি এক উন্নত মানের দর্জির দোকান চালু করেন।
ইসলাম ধর্মের প্রচারক:
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্য বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এদেশের মুসলমানদেরও ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। বাংলাদেশের সমস্ত গ্রাম-গঞ্জ শহর বাজারের খ্রীস্টান পাদ্রীদের খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারের প্রবল প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পায়। পাদ্রীদের নানা কুহেলিকাপূর্ণ কূট তর্কজাল সমাচ্ছন্ন বক্তৃতা শুনতে শুনতে অল্প বয়স্ক সত্যানুসন্ধিৎসু মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ বিচলিত হয়ে পড়েন। এরূপ এক সংকটকালীন মুহূর্তে প্রসিদ্ধ বক্তা ও ইসলাম প্রচারক হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ কর্তৃক লিখিত ‘খ্রীস্টান ধর্মের ভ্রষ্টতা’ নামক এবং প্রথম জীবনে খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারক ও পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম প্রচারক পাদ্রী ঈশান চন্দ্র মন্ডল ওরফে মুন্শী মোহাম্মদ এহসানুল্লাহর ‘ইনজিলে হয়রত মোহাম্মদের খবর আছে’ গ্রন্থ দু’খানি অধ্যয়নের পর তিনি নতুন আলোর সন্ধান পান।
ইসলামের নতুন তেজে নতুন শক্তিতে পূর্ণ হয়ে দীপ্ত মিহিরের ন্যায় নিত্য পরিপূর্ণ ও প্রতিভাত হতে লাগলেন। মুসলিম বীর মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ পাদ্রীদের অনুকরণে হাটে মাঠে ঘাটে তাঁদের বক্তৃতার তীব্র প্রতিবাদ শুরু করলেন। হাটের একদিকে পাদ্রীদের বক্তৃতা অন্য প্রান্তে মুন্শীর বক্তৃতা। অতি অল্প সময়ে তরুণ মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর ধর্ম প্রচারের ঘটনা গ্রামে, শহরে এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
মুন্শী সুদূর দার্জিলিং শহরেও দর্জির দোকান খুলেছিলেন এবং সেখানেও পাদ্রীদের একই অনাচার ও কার্যকলাপ দেখে তাঁর মন প্রাণ ব্যাকুল ও ব্যথিত হয়ে উঠলো। তিনি সেখানেও ধর্ম প্রচারের কাজ আরম্ভ করেন। ধর্ম-জ্ঞানে পরিপূর্ণতা লাভের জন্যে তিনি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন শুরু করেন। মুন্শী মেহেরুল্লাহ মহীশুর থেকে প্রকাশিত ‘মনসুরে মোহাম্মদী’ এবং হয়রত সোলায়মান ওয়ার্সির লেখা কেন আমি আমার পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করেছিলাম’, ‘কেন আমি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হয়েছিলাম’ ও ‘প্রকৃত সত্য কোথায়’ গ্রন্থগুলি পাঠ করে ব্যাপক উৎসাহিত ও উপকৃত হয়েছিলেন।
মেহেরুল্লাহ দার্জিলিং থেকে যশোরে ফিরে এসে আবার যশোরের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ম প্রচারের কাজে আত্ননিয়োগ করেন। এসময় তাঁর সহযোগী হিসেবে খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে ধর্ম প্রচারে অবতীর্ণ হতেন যশোরের ঘোপ এলাকার বাসিন্দা মুন্শী গোলাম রব্বানী ও ঘুরুলিয়ার মুন্শী মোহাম্মদ আব্দুল কাশেম।
মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ইসলাম ধর্ম প্রচারের এবং খ্রীস্টানদের মিথ্যা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জেহাদ ঘোষণা করেন এবং জেহাদকে সার্থক ও সফল করার লক্ষ্যে তিনি কলকাতার মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা মুন্শী রিয়াজ উদ্দিন আহাম্মদ ও মুন্শী আব্দুর রহিম প্রমুখ ধর্মপ্রাণ, মুসলিম হিতৈষী নেতাদের সাথে আলোচনা করেন। মুসলিম সমপ্রদায়ের কল্যাণ ও খ্রীস্টান পাদ্রিদের অপপ্রচারের হাত থেকে ইসলাম ধর্ম তথা মুসলিম সমাজকে রক্ষা করার অভিপ্রায়ে কলকাতার ‘না-খোদা’ মসজিদে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতি নামে এক সমিতি গঠন করা হয়। এই সমিতি কর্তৃক বাংলা ও আসামে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্যে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি বঙ্গ ও আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্দীপ্তময় যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলমানদের ভাঙ্গা বুক আবার সতেজ করে তোলেন।
খ্রীস্টান ধর্ম প্রচার মিশনের অন্যতম কর্তা রেভাঃ জন জমিরুদ্দিন ইসলাম ধর্ম প্রচারে এক সময় মুন্শী মেহেরুল্লাহর সঙ্গী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মুন্শী মেহেরুল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইসলাম ধর্মের ব্যাপক বিরোধিতা করেন।
সাহিত্য কর্ম:
১৮৯২ সালে জুন মাসে ‘খ্রীস্টীয় বান্ধব’ নামক মাসিক পত্রিকায় জন জমিরুদ্দিন ‘আসল কোরান কোথায়’ শীর্ষক এক বিভ্রান্তিমূলক প্রবন্ধ লেখেন। এই বিভ্রান্তিকর প্রবন্ধের জবাবে মুন্শী মেহেরুল্লাহ তৎকালীন প্রচলিত বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ পত্রিকায় (১৮৯২ সালের জুন মাসের ২০ ও ২৭ তারিখে) ‘ঈসায়ী বা খ্রীস্টানী ধোকা ভঞ্জন’ নামক সুদীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করে জন জমিরুদ্দিন কর্তৃক লিখিত ছয়টি প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ উত্তর প্রদান করেন। মেহেরুল্লাহর প্রবন্ধের উত্তরে জমিরুদ্দিন ‘সুধাকর’ পত্রিকাতেই ক্ষুদ্র আরেকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এর উত্তরে মুন্শী মেহেরুল্লাহ ‘আসল কোরান সর্বত্র’ নামক আর একটি দীর্ঘ ও তথ্য যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
জন জমিরুদ্দিন প্রবন্ধটি পড়ে নীরব হয়ে পড়েন। মুন্শী মেহেরুল্লাহর সহযোগী হবার আশা ব্যক্ত করে খ্রীস্টান হতে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জন জমিরুদ্দিন হতে শেখ মুন্শী জমিরুদ্দিন নাম ধারণ করেন।
খ্যাতিমান ইসলাম প্রচারক মুন্শী মেহেরুল্লাহর ধর্ম প্রচারের ইতিহাসে এটি এক বিষ্কয়কর ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। জমিরুদ্দিন কর্তৃক লিখিত ‘মেহের চরিত’ নামক গ্রন্থে তিনি মুন্শী মেহেরুল্লাহর ধর্ম প্রচার সম্পর্কে উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেছেন।
মুসলিম জাতির উন্নয়নে সাহিত্য ও সংবাদ পত্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির জন্যে অক্লান্ত প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন।
এ উদ্দ্যেশে তিনি চব্বিশ পরগণা নিবাসী শেখ আব্দুল রহিমের সাথে যোগাযোগ করেন। তখনকার দিনে মুন্শী আবদুর রহিমের সম্পাদনায় ও মুন্শী শেখ রিয়াজউদ্দীনের প্রকাশনায় কলকাতা থেকে মুসলিম ঐতিহ্যবাহী ‘সুধাকার’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। ‘মিহির’ ও ‘সুধাকার’ পত্রিকা দুটির উন্নতি ও প্রচারের জন্যে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর বিশেষভাবে প্রচেষ্টা চালান। ‘মিহির’ ও ‘সুধাকার’ নামক মাসিক পত্রিকারও তিনি পৃষ্ঠপোষকতা ও এই পত্রিকাগুলির নিয়মিত লেখক ছিলেন।
বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্যে ও জাতীয়তা গঠনের মূলে এই মনীষীসহ শেখ ফজলুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মৌলভী রেয়াজুদ্দিন আহাম্মদ, কবি মোজাম্মেল হক ও সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী’র নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য।
১৮৮৬ খৃঃ মুন্শী মেহেরুল্লাহ প্রথম প্রকাশিত বই ‘খ্রীস্ট ধর্মের অসারতা’ প্রকাশিত হয়। এই বইটি খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারকদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ও খ্রীস্টান ধর্মগ্রন্থ বাইবেল সম্পের্কে সমালোচনা করে লেখা।
তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘মেহেরুল এসলাম’। গ্রন্থখানির ভাষা অত্যন্ত সহজ সরল, সাধারণ পাঠকের বোঝার উপযোগ্য। গ্রন্থটি পুঁথি আকারে লিখিত। এই গ্রন্থে একেশ্বরবাদের মাহাত্ন্য প্রচারিত হয়েছে।
বিখ্যাত পারস্য কবি শেখ সাদির পান্দেনামা পুস্তকটি অনুবাদ করে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ লিখিত ‘রদ্দে খ্রীস্টান’ এবং ‘খ্রীস্টান ধর্মের অসারতা’ নামক পুস্তক দু’খানি তাঁর বক্তৃতা অপেক্ষা অনেক কার্য উপযোগী। এই পুস্তক দু’খানি যেন সারা দেশ ব্যাপি খ্রীস্টান পাদ্রীদের মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ‘রদ্দে খ্রীস্টান’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ড ‘দলিলুল ইসলাম’ প্রকাশের পূর্বেই মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ইন্তেকাল করেন।
মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা আর্জন করেছিল ‘বিধায় গঞ্জনা’ ও ‘হিন্দু ধর্ম রহস্য’। হিন্দু বিধবাদের জীবনের করুণ চিত্র মর্মষ্পর্শী ভাষায় সমালোচনাকারে গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণে ‘বিধবা গঞ্জনা’ গ্রন্থটি মুন্শী মেহেরুল্লাহর এক অপূর্ব সাহিত্য সৃষ্টি।
“দেবলীলা বা হিন্দু ধর্ম রহস্য’ নামক গ্রন্থটিতে পৌরাণিক দেবদেবীগণের লীলা খেলার কাহিনী নিয়ে রচিত। গ্রন্থটির ভিত্তি হচ্ছে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র। গ্রন্থ দু’খানিতে হিন্দু সমাজের সংকীর্ণতা ও বিধবাদের মনঃপীড়ার করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
মুন্শী মেহেরুল্লাহর মৃত্যুর পর কতিপয় স্বার্থান্বেষী হিন্দু সমাজপতির প্রচেষ্টায় ইংরেজ সরকার উক্ত পুস্তক দু’খানি বাজেয়াপ্ত করে এবং প্রকাশকের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
পরলোক গমন:
বঙ্গের অদ্বিতীয় বাগ্মী, ইসলাম ধর্ম প্রচারক মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ১৯০৭ সালের ৭ জুন শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় পরলোকগমন করেন।
মুন্সি মেহেরুল্লাহ স্মরণে :
এই কর্মবীর মুন্সি মেহেরুল্লাহর মুত্যুর পর তাঁর নিজ গ্রাম ছাতিয়ানতলায় তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্টেশন প্রতিষ্ঠা করে তার নামক

অসাধারণ বাগ্নী, সমাজসংস্কারক, ইসলাম প্রচারক মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ এর ১৯৯৫ সালের ৭ জুন ৮৭ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম তাঁর স্মৃতিকে আগামী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে মুন্শী মেহেরুল্লাহ এর ছবিসহ ডাকটিকিট ও স্মারক খামের উদ্বোধন করেন।
১৯০১ সালে মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ কর্তৃক যশোরের মনোহরপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় মাদ্রাসায়ে কেরামতিয়া। পরবর্তীতে তাঁর প্রচেষ্টায় মাদ্রাসাটি এম. ই স্কুলে রূপান্তরিত হয়ে আজকের পর্যায়ে উন্নীত হয়। এলাকাবাসী ও কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের উপাধ্যক্ষ মশিউল আযমের প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়টি এই কর্মবীরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নামকরণ করা হয় মুন্শী মেহেরুল্লাহ একাডেমী। পরে তাদের প্রচেষ্টায় মুন্শী মেহেরুল্লাহ সমাজকল্যাণ সংস্থা ও মুন্শী মেহেরুল্লাহ ফাউন্ডেশন গড়ে উঠে।
তথ্য সূত্র :
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ আপডেট :
মার্চ ২০১২
More information about Meherullah
sonarbangladesh.com
banglapedia.org
books.google.com.bd
bdstamps.com
somewhereinblog.net
sonarbangladesh.com
banglapedia.org
books.google.com.bd
bdstamps.com
somewhereinblog.net
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
মওলভী নয়, মাওলানা নয়, মুহাদ্দিস, মুফাসসির খেতাব নেই-পদবীর মধ্যে শুধু মুনশী। হ্যাঁ, শুধু মুনশী পদবীর অধিকারী একজন দরজির কথাই বলছি, যিনি নিজের ঈমান, সৎসাহস, আল্লাহপ্রেম এবং ইসলাম ও মুসলিম জাতির প্রতি আন্তরিক ভালবাসার কারণে জাতির এক দুঃসময় একই ইসলামের এত বিরাট খেদমত করে গেছেন, যার তুলনা অতি বিরল। খৃস্টান রাজত্বে খৃস্টধর্মের ব্যাপক প্রচার ও মুসলমানদের ধর্মান্তরকরণ রোধে, ক্ষুরধার যুক্তির সাহায্যে খৃস্টান ও হিন্দুধর্মের অসারতা প্রমাণে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় ইসলাম ত্যাগকারী পন্ডিত-বুদ্ধিজীবীদের পুনরায় ইসলামে আকৃষ্টকরণে, যাদুমন্ত্রের বক্তৃতা দ্বারা শ্রোতাদের প্রভাবিতকরণে, সাহিত্যক্ষেত্রে, সাহিত্যিক তৈরিতে, উপস্থিত বুদ্ধিতে, বক্তৃতাচ্ছলে বুদ্ধিদীপ্ত গল্প বলাতে, দুঃখীর দুঃখ মোচনে, সংবাদপত্রের সেবায়, সমাজ সংস্কারে, শিক্ষাবিস্তারে, উন্নত চারিত্রিক ও নৈতিক দৃঢ়তায় যিনি দেশ ও জাতি-ধর্মের সেবায় এ দেশের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্তের স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তিনি হচ্ছেন যশোরের মুনশী মেহেরুল্লাহ। মুনশী মেহেরুল্লাহ বাংলাভাষী মুসলমানদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণে কত বড় অবদান রেখে গেছেন, তারই ভাবশিষ্য ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সুবিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অনল প্রবাহ'-এ মুনশী মেহেরুল্লাহর মৃত্যুতে প্রকাশিত বেদনা, মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ এবং কবি নজরুল প্রমুখের উক্তি থেকে তা অনুমেয়। সিরাজী তার ইন্তিকালে ভক্তি গদ গদ কণ্ঠে লিখেছেন:
‘‘একি অকস্মাৎ হল বজ্রপাত। কি আর লিখিবে কবি।
বঙ্গের ভাস্কর প্রতিভা আকর অকালে লুকাল ছবি।
কি আর লিখিব কি আর বলিব, অাঁধার যে হেরি ধরা।
আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল খসিয়া কক্ষচ্যুত গ্রহ তারা।
কাঁপিল ভূধর কানন সাগর প্রলয়ের প্রভঞ্জনে,
বহিল তুফান ধ্বংসের বিষাণ বাজিল ভীষণ সনে!
ছিন্ন হ'ল বীণ কল্পনা উড়িল কবিত্ব পাখী,
মহা শোকানলে সব গেল জ্বলে শুধু জলে ভাসে অাঁখি।
কি লিখিব আর, শুধু হাহাকার শুধু পরিতাপ ঘোর,
অনন্ত ক্রন্দন অনন্ত বেদন রহিল জীবনে মোর।
মধ্যাহ্ন তপন ছাড়িয়া গগন হায়রে খসিয়া প'ল,
সুধা মন্দাকিনী জীবনদায়িনী অকালে বিশুষ্ক হ'ল।
বাজিতে বাজিতে মোহিতে মোহিতে অকালে থামিল বীণ,
প্রভাত হইতে দেখিতে দেখিতে অাঁধারে মিশিল দিন।
মলয় পবন সুখ পরশন থামিল বসন্ত ভোরে,
গোলাপ কুসুম চারু অনুপম প্রভাতে পড়িল ঝরে।
ভবের সৌন্দর্য্য সৃষ্টির ঐশ্বর্য্য শারদের পূর্ণ শশী,
উদিতে উদিতে হাসিতে হাসিতে রাহুতে ফেলিল গ্রাসি।
জাগিতে জাগিতে উঠিতে উঠিতে নাহি হ'ল দরশন,
এ বঙ্গ-সমাজ সিন্ধুনীরে আজ হইলরে নির্গমন।
এই পতিত জাতি অাঁধারেই রাতি পোহাবে চিরকাল,
হবে না উদ্ধার বুঝিলাম সার কাটিবে না মোহজাল।
সেই মহাজন করিয়া যতন অপূর্ব বাগ্মিতাবলে,
নিদ্রিত মোসলেমে ঘুরি গ্রামে গ্রামে জাগাইলা দলে দলে।
যার সাধনায় প্রতিভা প্রভায় নূতন জীবন ঊষা,
উদিল গগনে মধুর লগনে পরিয়া কুসুম ভূষা।
আজি সে তপন হইল মগন অনন্ত কালের তরে,
প্রবল অাঁধার তাই একেবারে আবরিছে চরাচরে।
বক্তৃতা তরঙ্গে এ বিশাল বঙ্গ ছুটিল জীবন ধারা,
মোসলেম-বিদ্বেষী যত অবিশ্বাসী বিস্ময়ে স্তম্ভিত তারা।
হায়! হায়! হায়! হৃদি কেটে যায় অকালে সে মহাজন,
কাঁদায়ে সবারে গেল একেবারে অাঁধারিয়া এ ভুবন।
কেহ না ভাবিল কেহ না বুঝিল কেমনে ডুবিল বেলা,
ভাবিনি এমন হইবে ঘটন সবাই করিনু হেলা।
শেষ হল খেলা ডুবে গেল বেলা অাঁধার আইল ছুটি,
বুঝিবি এখন বঙ্গবাসিগণ কি রতন গেল উঠি।
গেল যে রতন হায় কি কখন মিলিবে মাজে আর?
মধ্যাহ্ন তপন হইল মগন বিশ্বময় অন্ধকার।'
মুনশী মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে যশোরের ঘোপ নামক এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এ দেশে ইংরেজ শাসনের তখন ১০৪ বছর। তাঁর জন্মের চার বছর আগে ১৮৫৭ সালে মুসলমানরা ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে নিজেদের হৃদ আযাদী পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে হেরে যায়। ইংরেজরা তারপর থেকে মুসলমানদের ওপর কেবল জুলুম-নিপীড়নই চালায়নি, তারা এ জাতিকে সকল দিক থেকে চিরতরে দুর্বল করার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মুসলিম বিরোধী অভিযানে প্রবৃত্ত হয়। ইংরেজদের সাথে মুসলিম বৈরিতার কাজে পটু সহযোগীর ভূমিকা পালন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ। ইংরেজদের মুসলিম বিরোধী এই অভিযানের একটি অঙ্গ ছিল মুসলমানদের খৃস্টান মিশনারী পাদরীদের দ্বারা ধর্মান্তরিতকরণ। এ দ্বিমুখী বরং বহুমুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মুসলমানদের অনেক দায়িত্বশীল নেতা সে সময় জাতির অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ইংরেজ সরকারের সাথে আপোসকামিতার নীতি অবলম্বনে বাধ্য হন। এই উপমহাদেশের মুসলমানদের সেই দুর্দিনে যশোরের মুনশী মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ এগিয়ে আসেন। বৃটিশ শাসকদের অনুকূলে ও ছত্রছায়ায় খৃস্টান মিশনারীদের ইসলাম বিরোধী অপপ্রচারে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করা এবং তাদের খৃস্টান বানানোর দ্বারা এ দেশে ইংরেজ শাসনকে পাকাপোক্ত ও মুসলিম জাতিসত্তাকে বিলুপ্ত করাই ছিল দুশমনদের আসল লক্ষ্য। মুনশী মেহেরুল্লাহ তখন রাজশক্তির চোখ রাঙানি বা নির্যাতনের কোনো পরোয়ানা করে এ দেশের হাটে মাঠে ঘাটে ইসলামের বিপ্লবী বাণী প্রচার করতে লাগলেন। হতোদ্যম, প্রাণস্পন্দনহীন মজলুম মুসলিম সমাজকে তিনি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। দেশের আনাচে-কানাচে সভাসমিতি করে জ্বালাময়ী ভাষায় যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা দিয়ে, গদ্যে-পদ্যে অনেক বই লিখে, মুসলিম জাতির মনে নতুন আশার ও আস্থার সঞ্চার করেন। মুনশী মেহেরুল্লাহ মুসলিম জাতির জাগরণ ও আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি এবং তাদের ঈমান-আকীদায় আপতিত বিভ্রান্তির কলুষতা দূরীকরণে যেই নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন, বিংশ শতকে তার ফলস্বরূপ এ জাতির মধ্যে দেখা দেয় বিরাট ইসলামী পুনর্জাগরণ। মুনশী মেহেরুল্লাহর আন্দোলনের প্রভাবে পরবর্তীকালে এ দেশে তাঁর বহু ভাবশিষ্যের জন্ম হয়। বাংলার সর্বপ্রধান বাগ্মী, সমাজসেবক, মুসলমানদের পথ প্রদর্শক ও সমাজ সংস্কারক কবি, গ্রন্থকার ও ধর্মপ্রচারক মুনশী মেহেরুল্লাহ জানতেন বক্তৃতার প্রভাব অস্থায়ী। সাহিত্য ও সংবাদপত্র জাতির মেরুদন্ডতুল্য। এসবের মাধ্যমেই জাতিকে স্থায়ীভাবে সঠিক পথের সন্ধান দেয়া যায়। বিরুদ্ধবাদীদের মোকাবিলা করতে এবং নিজের শিক্ষা আদর্শকে সুষ্ঠুভাবে অপরের সামনে তুলে ধরতে হলে কলম-যুদ্ধের বিশেষ প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে তিনি সমাজে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সৃষ্টির জন্য ও সংবাদপত্র প্রকাশে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বহু লেখককে তিনি সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তী জীবনে সাহিত্য, ধর্ম ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য আসন অধিকার করেন। অনল প্রবাহের কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কাকিনার বিখ্যাত কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্যবিশারদ, যশোরের খ্যাতনামা কবি শেখ হাবীবুর রহমান সাহিত্যরত্ন, মুনশী মেহেরুল্লাহর নিকট হতে তাদের সাহিত্যিক জীবনের ঊষালগ্নে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা পেয়েছিলেন, তা আজ এ দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিশেষ আলোচ্য বিষয়। মুনশী মেহেরুল্লার মতে ‘‘সাহিত্য সৃষ্টির জন্য আমাদের উচ্চতর ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়নের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই ছন্দ অলংকারের। শিশু তার মায়ের সঙ্গে কি ভাষায় কথা বলে? ক্ষুধা পেলেই সে কাঁদে, আনন্দে হাসে, ইঙ্গিতে নানা ভাব প্রকাশ করে। এই প্রকাশ থেকে মা যেমন শিশুর ভাষা বুঝে তার অভিলাষ পূরণ করতে এগিয়ে যায়, তেমনি অল্পশিক্ষিত বাঙ্গালী মুসলমানগণ উচ্চতর ভাষা বা সাহিত্যতত্ত্বে অভিজ্ঞ না হয়েও বিশ্বসাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন। সে সাহিত্য সুশিক্ষিত বিদ্বজ্জনের মনের দুয়ারে জোয়ার সৃষ্টি হয়তো না করতে পারে কিন্তু প্রাণের ভাষায় প্রাণের কথা তো বলতে পারে। সন্তানের ভাষা মা জননীর মহান প্রাণের দুয়ারে আঘাত করতে পারবে না কেন?’’
মুনশী মেহেরুল্লাহ তাঁর সাহিত্যকর্ম ও চিন্তার দ্বারা এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সত্য প্রমাণ করে গেছেন। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত সাহিত্যিক কবি মুহাম্মদ আবু তালিব আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘সুশিক্ষিত মাতৃভাষাভিজ্ঞ সুধীমন্ডলীর নয়- তিনি ভাষাহারা বঙ্গীয় মুসলমানদের স্নেহ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, এই তরুণ সমাজকে নিয়ে তিনি যখন দিগ্বিজয়ে বের হলেন, দেখা গেল এক এক করে বন্ধ ‘সিসেম' খুলে যাচ্ছে।’’
‘‘মুনশী সাহেব তাঁর মেহেরুল এছলাম’’ কাব্যে যে ভাষা ব্যবহার করেছিলেন, এ ভাষা বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন ব্যবহার করতে পারেননি। কিন্তু মুনশী সাহেব এ ভাষা শুধু ব্যবহারই করেননি, সার্থকভাবেই তার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। তিনি নিজে সাহিত্য চর্চা করেছেন এবং ভবিষ্যতে সাহিত্য সাধনার জন্য একটি শক্তিশালী নিবেদিতচিত্ত সাহিত্য সাধক দল গঠনের কাজও আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। মুনশী সাহেবের সেই উত্তরসূরিরা হলেন ১. ইসমাইল হোসেন সিরাজী, যাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘অনল প্রবাহ'। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মুনশী সাহেবকে না দেখলেও সিরাজী সাহেবের ‘অনল প্রবাহ' তাঁর জীবনে যে দাহের সৃষ্টি করেছিল, তারই ফল ছিল তাঁর ‘অগ্নিবীণা'। ২. শেখ হাবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন ৩. কবি মুহাম্মদ গোলাম হোসেন ৪. মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন বিদ্যাবিনোদ ৫. মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ ও মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন কাব্যবিনোদ প্রমুখ। মুনশী মেহেরুল্লাহ সম্পর্কে মাওলানা আকরম খাঁ লেখেছেন : তাঁর জীবনে ও সাহিত্যে দেশপ্রেমের যে স্ফূরণ ঘটেছিল, তার মূল প্রেরণা এসেছিল কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহর কাছ থেকে। ‘‘কর্মজীবনের প্রারম্ভে স্ব-সমাজের দৈন্য-দুর্দশায় যে তীব্র অনুভূতি আমার মন ও মস্তিষ্ককে বিচলিত করিয়া তুলিয়াছিল, আপনাদেরই একজন ক্ষণজন্মা মুসলমান কর্মবীরের (মুনশী মেহেরুল্লা) সাধনা আদর্শ তাহার মূলে অনেকটা প্রেরণা যোগাইয়া দিয়াছিল। (নড়ছিলে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ কংগ্রেসের সভায় সভাপতিরূপে মাওলানার প্রদত্ত ভাষণ।)
মুনশী মেহেরুল্লাহ সম্পর্কে তাঁর অন্তরঙ্গ সহচর মুনশী শেখ জমিরুদ্দীনের মন্তব্য হলো, ‘‘যিনি বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে সভাসমিতি অধিবেশনের সূত্রপাত করিয়াছেন, যিনি খৃস্টীয় ধর্মসংক্রান্ত পুস্তকাদি লিখিয়া পাদ্রী ও খৃস্টানদিগের বিষদন্ত ভগ্ন করিয়াছেন, যিনি ইসলাম ধর্ম ও সমাজের উন্নতির জন্য জীবনোৎসর্গ করিয়াছেন, সেই মুসলিম মূল রত্ন, বাগ্নী মুলতিলক মুনশী মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ সাহেব।’’
মুনশী মেহেরুল্লাহর নিজ বাড়ি ছিল যশোর জেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামে। স্থানটি বর্তমান যশোর ঝিনাইদা প্রাচীন রেলরাস্তার পাশে (পাঁচ ছয় মাইলের কাছে) চুড়ামনকাঠি নামক রেল স্টেশনের সন্নিকটে অবস্থিত। ১৯৪৯ খৃস্টাব্দের পাকিস্তান আমলে স্টেশনটির নামকরণ করা হয় মেহেরুল্লাহ নগর। মুনশী মেহেরুল্লার পূর্বপুরুষরা খাঁ উপাধিধারী ছিলেন। যেমন তাঁর কুরসী বা বংশলতিকায় দেখা যায়, তাঁর পিতার নাম ওয়ারিস উদ্দীন, তদীয় পিতা নাসির মামুদ, তদীয় পিতা শাহ মামুদ খাঁ, তদীয় পিতা আকেল মামুদ খাঁ, তদীয় পিতা দুলায়েব খাঁ, তদীয় পিতা মুনায়েম খাঁ (মনু খাঁ) মুনশী সাহেবের পিতা একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর পাঁচ বছর বয়সের সময় পিতৃবিয়োগ ঘটে। ঐ বছরই তাঁকে পাঠশালায় ভর্তি করা হয়। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি তৎকালীন বর্ণ পরিচয় শেষ করে ফেলেন। স্বামীর মৃত্যুতে মেহের জননী চারি দিক অন্ধকার দেখতে লাগলেন। জীবনের সকল আশা-ভরসার স্থল শিশুপুত্রকে বুকে নিয়ে তিনি কষ্টে দিনযাপন করতে লাগলেন।
মুনশী মেহেরুল্লাহ প্রায় চৌদ্দ বছর বয়সের সময় লেখাপড়া শিক্ষার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেন। তিনি কয়ালখালি গ্রামের মওলভী মোনহাব উদ্দীন সাহেবের কাছে তিন বছর বিদ্যা শিক্ষা করেন। তারপর তিনি করটিয়ার মুহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের কাছে আরবি, উর্দু ও ফারসী শিক্ষা করেন। বলাবাহুল্য, জীবনের প্রথম দিকের এই ফারসী ও উর্দু শিক্ষা তাঁর প্রচারক জীবনে বিরাট কাজে আসে। মুনশী মেহেরুল্লাহর জ্ঞানস্পৃহা ছিল অতি অদম্য। তিনি অযথা সময় নষ্ট না করে পড়াশোনায় কাটাতেন। দরজি দোকানে শিক্ষানবিশীকালেও তিনি অবসর সময় তাজ মামুদের নিকট উর্দু পড়তেন ও উর্দু সাহিত্যের চর্চার আসরে উপস্থিত হতেন। সাহিত্যামোদী অনেকে দর্জি দোকানের এই সাহিত্য চর্চার আসরে উপস্থিত হতেন। ইরানের অমর কবি শেখ সাদীর গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ কিতাবদ্বয়ের কবিতা-গল্প তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। কুরআন-হাদিসের জ্ঞানেও তিনি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তাঁর গলার সুর ছিল মধুর। তাঁর সুললিত কণ্ঠের ফারসী বয়াত সভা-সমিতির শ্রোতাদেরকে অভিভূত করে ফেলত।
জ্ঞান আহরণের উৎসাহ-বাসনা থাকলে অর্থাভাবের মধ্য দিয়েও বহু লোকের জ্ঞানীগুণী ও বড় হবার নজির পৃথিবীতে রয়েছে। দারিদ্রে্যর দুঃসহ বাধার প্রাচীর তাদেরকে জ্ঞানসাধনা ও জীবনে বড় হবার সংকল্প থেকে দূরে সরাতে পারেনি। তেমনি দারিদ্রে্যর অক্ষমতা ও কষাঘাত অনেক প্রতিভাধর ছাত্রছাত্রীর জীবনপুকে বিকশিত হবার আগেই এ পথ থেকে যে সরে যেতে বাধ্য করে, সে বাস্তবতাও অস্বীকার করার মতো নয়। মুনশী মেহেরুল্লাহ যৌবন-সীমায় পদার্পন করলে তাঁর ওপরও সংসারের চাপ এত বেশি বৃদ্ধি পায় যে, তাঁর পক্ষে ছাত্রজীবনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হলো না। রুজি-রোজগারের অন্বেষণে তাঁকে বের হতে হলো। প্রথমে একটি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড অফিসে একটি ছোটখাটো চাকরি নিলেন। কিন্তু চাকরি জীবনের বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে তিনি থাকতে পারলেন না। মুক্ত বিহঙ্গকে খাঁচায় রাখা যায় না। মুনশী মোহেরুল্লাহ স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের উপযোগী কোনো পেশায় নিয়োজিত হবার চিন্তা করলেন। খোঁজার হাটে একটি দরজি দোকানে সেলাই কাজ শিখতে লাগলেন। এ সাথে তিনি পড়ার কাজও অব্যাহত রাখেন। এ সময়ই তিনি উর্দু, ফারসী শেখেন যা পূর্বে বলা হয়েছে। এ সময় উর্দু সাহিত্য, আরবি-ফারসী বিষয়ক জ্ঞানের চর্চার মধ্যে দিয়ে তিনি ইসলামী কৃষ্টি-সংস্কৃতি, তাহজিব-তমদ্দুন সম্পর্কে যে নতুন জ্ঞান ও ধারণা লাভ করেন, তাঁর উজ্জ্বল কর্মজীবনে এটি বিরাট পাথেয়স্বরূপ কাজ করে। দরজির কাজ আয়ত্তে এনে মুনশী সাহেব যশোর শহরের দড়াটানা রোডে নিজেই একটি দোকান খুলে বসলেন। তাঁর সুমধুর ও অমায়িক ব্যবহারে শহরের অনেক বিশিষ্ট লোক এসে তাঁর কাছে বসতেন। খোদ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও তাঁর দোকানের একজন খরিদ্দার ছিলেন।
ঠিক ঐ সময়ে খৃস্টানরা বাংলার সর্বত্র ব্যাপকভাবে খৃস্ট ধর্মের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জ, হাটবাজার সর্বত্রই প্রাদ্রীরা খৃস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে বেড়াচ্ছিল এবং এ দেশের মুসলমানদের ধর্মচ্যুত করছিল। তারা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা প্রচারণা চালাতো এবং সাধারণ লোকদের বিভ্রান্ত করত। মুন্সী মেহেরুল্লাহর দোকানের সামনেও রাস্তার ওপর পাদ্রীরা এভাবে বক্তৃতা দিচ্ছিল এবং ইসলামকে মানুষের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা কাহিনী এবং কুরআন শরীফের অপব্যাখ্যা করতে শুরু করল। মুনশী মেহেরুল্লাহ তাদের এ প্রেরণা দেখে এবং ‘সুসমাচার' নামে একটি বই প্রচার করতে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। কারণ, এ বইটি সরলপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করছিল। তিনি মিশনারীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দানের জন্য প্রস্তুত হলেন এবং ‘মনসুরে মুহাম্মদী' নামক একখানা উর্দু পত্রিকার গ্রাহক হলেন। এ পত্রিকা পাঠে তাঁর জ্ঞানপরিধি অনেক বৃদ্ধি পায়। তিনি প্রথমে খৃস্টান পাদ্রী-পুরোহিতদের প্রচার পত্রিকা ও বাইবেলের অনুবাদগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। ইতোমধ্যে তাঁর হাতে দু'খানা বই এসে গেল। এর একখানা হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ রচিত ‘খৃস্টান ধর্মের ভ্রষ্টতা' আর অপরটি পাদ্রী ইশানচন্দ্র ওরফে মুনশী মুহাম্মদ এহসান উল্লাহ রচিত ‘ইঞ্জিলেও হযরত মুহাম্মদের খবর আছে'। মুনশী মেহেরুল্লাহ পাদ্রীদের সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে লাগলেন। যেখানে খৃস্টান পাদ্রীরা তাদের ধর্ম প্রচার করতেন, সেখানেই তিনি ঈমানী চেতনা নিয়ে ছুটে যেতেন। জনসাধারণ হাটে-বাজারে, সভা-সমাবেশে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের সৃষ্টি করতো। খৃস্টান পাদ্রীরা অবস্থা বেগতিক দেখে অনেক এলাকা থেকে চলে যায়। এভাবে মুনশী সাহেবের নাম দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় জনসভায় বক্তৃতাদানের জন্য তার কাছে দাওয়াত আসতে থাকে। তিনি অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে এসব দাওয়াতে সাড়া দিতেন এবং জনগণের মধ্যে ধর্মীয় চেতনার সৃষ্টি করতে লাগলেন।
যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দার্লিজিং বদলি হয়ে গেলে তাঁর অনুরোধে মুনশী সাহেবও সেখানে গেলেন এবং একটি দর্জি দোকান খুললেন। এখানে এসেও তিনি জ্ঞানচর্চায় প্রবৃত্ত হলেন। দার্জিলিংয়ে তিনি বিভিন্ন ধর্মের গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করেন। বেদ উপনিষদ, বাইবেল, ত্রিপিটক, গ্রন্থ সাহেব, গীতা প্রভৃতি তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন ‘তোহফাতুল-মোবতাদী' নামক একখানা উর্দু গ্রন্থ পাঠে তিনি বৈদিক ধর্মের অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি অবহিত হন। তিনি মিশর থেকে সোলায়মান ওয়াসী লিখিত ‘কেন আমি পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করেছিলাম' ‘কেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হয়েছিলাম' ‘প্রকৃত সত্য কোথায়?' এ তিনখানা গ্রন্থ সংগ্রহ করার পর খৃস্ট ধর্মের সাথে মোকাবেলা করার জন্য তাকে আর কোন চিন্তা করতে হলো না। এখন তিনি আর দর্জির দোকানে আবদ্ধ থাকতে চান না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি আপত্তি করলেন না। এরপর থেকে মুনশী মেহেরুল্লাহ খৃস্টান মিশনারীদের কাজের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
মেহেরুল্লাহ এখন পুরোপুরি ইসলামের কাজে নিয়োজিত। তিনি তৎকালীন মুসলিম সমাজসেবকদের সাথে যোগাযোগ করবেন। কলকাতা গিয়ে ‘মিহির' পত্রিকার সম্পাদক মুনশী রেয়াজুদ্দীন আহমদ, ‘সুধাকর' সম্পাদক মুনশী আবদুর রহিম, মুনশী মেয়ারাজুদ্দীন আহমদ, পন্ডিত রিয়াজুদ্দীন মাশহাদী প্রমুখের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। কলকাতা নাখোদা মসজিদে একটি সভার আয়োজন করেন। এ সভার আয়োজনে খান বাহাদুর বদরুদ্দীন হায়দার, খানবাহাদুর নূর মুহাম্মদ জাকরিয়া প্রমুখ চিন্তাবিদ সহায়তা করেছেন। সভায় ‘নিখিল ভারত ইসলাম সমিতি' নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা-আসামে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মুনশী মেহেরুল্লাহর ওপরে। সর্বত্র তাঁর সাথে খৃস্টান পাদ্রীদের বহাস হতে থাকে। কিন্তু সর্বত্রই এই যুক্তিবাদী বক্তার কাছে পাদ্রীরা হার মানতে লাগলেন। ‘খৃস্টান বান্ধব' নামে মিশনারীদের একটি প্রচারপত্র ছিল। এতে খৃস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে জন জমিরুদ্দীন ১৮৯২ সালে ‘আসল কুরআন কোথায়' এ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধে বলা হয়, ‘হযরত মুহাম্মদের প্রচারিত কোরআনের সাথে আসল কোরআনের মিল নেই।' মুনশী মেহেরুল্লাহ সুধাকর পত্রিকায় তার জবাবে লিখলেন ‘খৃস্টানী ধোঁকা ভঞ্জন।' জন জমিরুদ্দীন এর কোনো জবাব দিতে পারলেন না, বরং এতে নতুন জ্ঞানের সন্ধান পেয়ে মুনশী সাহেবের কাছে ছুটে গেলেন এবং পুনরায় মুসলমান হয়ে গেলেন।
মুনশী মেহেরুল্লাহ খৃস্টান মিশনারীদের দ্বারা বাংলা আসামের মুসলমানদের ধর্মান্তর রোধে ঝাঁপিয়ে না পড়লে এ দেশে হয়তো আজ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা টিকে থাকতো না। এদিক থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সহজেই অনুমেয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে একই ফিতনা আবার দেখা দিয়েছে। কিন্তু দেশের ওলামা-মাশায়েখের সেই তুলনায় যা করার দরকার ছিল, তা হচ্ছে না। ফলে অনেকে আশঙ্কা করছেন যে, না জানি বাংলাদেশ একদিন লেবাননে পরিণত হয়। মুনশী মেহেরুল্লাহ ১৯০৭ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৪ বাংলা রোজ শুক্রবার ১টার সময় ৪৬ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
তথ্যসূত্র: দৈনিক সংগ্রাম
‘‘একি অকস্মাৎ হল বজ্রপাত। কি আর লিখিবে কবি।
বঙ্গের ভাস্কর প্রতিভা আকর অকালে লুকাল ছবি।
কি আর লিখিব কি আর বলিব, অাঁধার যে হেরি ধরা।
আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল খসিয়া কক্ষচ্যুত গ্রহ তারা।
কাঁপিল ভূধর কানন সাগর প্রলয়ের প্রভঞ্জনে,
বহিল তুফান ধ্বংসের বিষাণ বাজিল ভীষণ সনে!
ছিন্ন হ'ল বীণ কল্পনা উড়িল কবিত্ব পাখী,
মহা শোকানলে সব গেল জ্বলে শুধু জলে ভাসে অাঁখি।
কি লিখিব আর, শুধু হাহাকার শুধু পরিতাপ ঘোর,
অনন্ত ক্রন্দন অনন্ত বেদন রহিল জীবনে মোর।
মধ্যাহ্ন তপন ছাড়িয়া গগন হায়রে খসিয়া প'ল,
সুধা মন্দাকিনী জীবনদায়িনী অকালে বিশুষ্ক হ'ল।
বাজিতে বাজিতে মোহিতে মোহিতে অকালে থামিল বীণ,
প্রভাত হইতে দেখিতে দেখিতে অাঁধারে মিশিল দিন।
মলয় পবন সুখ পরশন থামিল বসন্ত ভোরে,
গোলাপ কুসুম চারু অনুপম প্রভাতে পড়িল ঝরে।
ভবের সৌন্দর্য্য সৃষ্টির ঐশ্বর্য্য শারদের পূর্ণ শশী,
উদিতে উদিতে হাসিতে হাসিতে রাহুতে ফেলিল গ্রাসি।
জাগিতে জাগিতে উঠিতে উঠিতে নাহি হ'ল দরশন,
এ বঙ্গ-সমাজ সিন্ধুনীরে আজ হইলরে নির্গমন।
এই পতিত জাতি অাঁধারেই রাতি পোহাবে চিরকাল,
হবে না উদ্ধার বুঝিলাম সার কাটিবে না মোহজাল।
সেই মহাজন করিয়া যতন অপূর্ব বাগ্মিতাবলে,
নিদ্রিত মোসলেমে ঘুরি গ্রামে গ্রামে জাগাইলা দলে দলে।
যার সাধনায় প্রতিভা প্রভায় নূতন জীবন ঊষা,
উদিল গগনে মধুর লগনে পরিয়া কুসুম ভূষা।
আজি সে তপন হইল মগন অনন্ত কালের তরে,
প্রবল অাঁধার তাই একেবারে আবরিছে চরাচরে।
বক্তৃতা তরঙ্গে এ বিশাল বঙ্গ ছুটিল জীবন ধারা,
মোসলেম-বিদ্বেষী যত অবিশ্বাসী বিস্ময়ে স্তম্ভিত তারা।
হায়! হায়! হায়! হৃদি কেটে যায় অকালে সে মহাজন,
কাঁদায়ে সবারে গেল একেবারে অাঁধারিয়া এ ভুবন।
কেহ না ভাবিল কেহ না বুঝিল কেমনে ডুবিল বেলা,
ভাবিনি এমন হইবে ঘটন সবাই করিনু হেলা।
শেষ হল খেলা ডুবে গেল বেলা অাঁধার আইল ছুটি,
বুঝিবি এখন বঙ্গবাসিগণ কি রতন গেল উঠি।
গেল যে রতন হায় কি কখন মিলিবে মাজে আর?
মধ্যাহ্ন তপন হইল মগন বিশ্বময় অন্ধকার।'
মুনশী মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে যশোরের ঘোপ নামক এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এ দেশে ইংরেজ শাসনের তখন ১০৪ বছর। তাঁর জন্মের চার বছর আগে ১৮৫৭ সালে মুসলমানরা ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে নিজেদের হৃদ আযাদী পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে হেরে যায়। ইংরেজরা তারপর থেকে মুসলমানদের ওপর কেবল জুলুম-নিপীড়নই চালায়নি, তারা এ জাতিকে সকল দিক থেকে চিরতরে দুর্বল করার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মুসলিম বিরোধী অভিযানে প্রবৃত্ত হয়। ইংরেজদের সাথে মুসলিম বৈরিতার কাজে পটু সহযোগীর ভূমিকা পালন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ। ইংরেজদের মুসলিম বিরোধী এই অভিযানের একটি অঙ্গ ছিল মুসলমানদের খৃস্টান মিশনারী পাদরীদের দ্বারা ধর্মান্তরিতকরণ। এ দ্বিমুখী বরং বহুমুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মুসলমানদের অনেক দায়িত্বশীল নেতা সে সময় জাতির অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ইংরেজ সরকারের সাথে আপোসকামিতার নীতি অবলম্বনে বাধ্য হন। এই উপমহাদেশের মুসলমানদের সেই দুর্দিনে যশোরের মুনশী মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ এগিয়ে আসেন। বৃটিশ শাসকদের অনুকূলে ও ছত্রছায়ায় খৃস্টান মিশনারীদের ইসলাম বিরোধী অপপ্রচারে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করা এবং তাদের খৃস্টান বানানোর দ্বারা এ দেশে ইংরেজ শাসনকে পাকাপোক্ত ও মুসলিম জাতিসত্তাকে বিলুপ্ত করাই ছিল দুশমনদের আসল লক্ষ্য। মুনশী মেহেরুল্লাহ তখন রাজশক্তির চোখ রাঙানি বা নির্যাতনের কোনো পরোয়ানা করে এ দেশের হাটে মাঠে ঘাটে ইসলামের বিপ্লবী বাণী প্রচার করতে লাগলেন। হতোদ্যম, প্রাণস্পন্দনহীন মজলুম মুসলিম সমাজকে তিনি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। দেশের আনাচে-কানাচে সভাসমিতি করে জ্বালাময়ী ভাষায় যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা দিয়ে, গদ্যে-পদ্যে অনেক বই লিখে, মুসলিম জাতির মনে নতুন আশার ও আস্থার সঞ্চার করেন। মুনশী মেহেরুল্লাহ মুসলিম জাতির জাগরণ ও আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি এবং তাদের ঈমান-আকীদায় আপতিত বিভ্রান্তির কলুষতা দূরীকরণে যেই নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন, বিংশ শতকে তার ফলস্বরূপ এ জাতির মধ্যে দেখা দেয় বিরাট ইসলামী পুনর্জাগরণ। মুনশী মেহেরুল্লাহর আন্দোলনের প্রভাবে পরবর্তীকালে এ দেশে তাঁর বহু ভাবশিষ্যের জন্ম হয়। বাংলার সর্বপ্রধান বাগ্মী, সমাজসেবক, মুসলমানদের পথ প্রদর্শক ও সমাজ সংস্কারক কবি, গ্রন্থকার ও ধর্মপ্রচারক মুনশী মেহেরুল্লাহ জানতেন বক্তৃতার প্রভাব অস্থায়ী। সাহিত্য ও সংবাদপত্র জাতির মেরুদন্ডতুল্য। এসবের মাধ্যমেই জাতিকে স্থায়ীভাবে সঠিক পথের সন্ধান দেয়া যায়। বিরুদ্ধবাদীদের মোকাবিলা করতে এবং নিজের শিক্ষা আদর্শকে সুষ্ঠুভাবে অপরের সামনে তুলে ধরতে হলে কলম-যুদ্ধের বিশেষ প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে তিনি সমাজে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সৃষ্টির জন্য ও সংবাদপত্র প্রকাশে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বহু লেখককে তিনি সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তী জীবনে সাহিত্য, ধর্ম ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য আসন অধিকার করেন। অনল প্রবাহের কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কাকিনার বিখ্যাত কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্যবিশারদ, যশোরের খ্যাতনামা কবি শেখ হাবীবুর রহমান সাহিত্যরত্ন, মুনশী মেহেরুল্লাহর নিকট হতে তাদের সাহিত্যিক জীবনের ঊষালগ্নে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা পেয়েছিলেন, তা আজ এ দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিশেষ আলোচ্য বিষয়। মুনশী মেহেরুল্লার মতে ‘‘সাহিত্য সৃষ্টির জন্য আমাদের উচ্চতর ভাষাবিজ্ঞান অধ্যয়নের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই ছন্দ অলংকারের। শিশু তার মায়ের সঙ্গে কি ভাষায় কথা বলে? ক্ষুধা পেলেই সে কাঁদে, আনন্দে হাসে, ইঙ্গিতে নানা ভাব প্রকাশ করে। এই প্রকাশ থেকে মা যেমন শিশুর ভাষা বুঝে তার অভিলাষ পূরণ করতে এগিয়ে যায়, তেমনি অল্পশিক্ষিত বাঙ্গালী মুসলমানগণ উচ্চতর ভাষা বা সাহিত্যতত্ত্বে অভিজ্ঞ না হয়েও বিশ্বসাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন। সে সাহিত্য সুশিক্ষিত বিদ্বজ্জনের মনের দুয়ারে জোয়ার সৃষ্টি হয়তো না করতে পারে কিন্তু প্রাণের ভাষায় প্রাণের কথা তো বলতে পারে। সন্তানের ভাষা মা জননীর মহান প্রাণের দুয়ারে আঘাত করতে পারবে না কেন?’’
মুনশী মেহেরুল্লাহ তাঁর সাহিত্যকর্ম ও চিন্তার দ্বারা এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সত্য প্রমাণ করে গেছেন। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত সাহিত্যিক কবি মুহাম্মদ আবু তালিব আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘সুশিক্ষিত মাতৃভাষাভিজ্ঞ সুধীমন্ডলীর নয়- তিনি ভাষাহারা বঙ্গীয় মুসলমানদের স্নেহ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, এই তরুণ সমাজকে নিয়ে তিনি যখন দিগ্বিজয়ে বের হলেন, দেখা গেল এক এক করে বন্ধ ‘সিসেম' খুলে যাচ্ছে।’’
‘‘মুনশী সাহেব তাঁর মেহেরুল এছলাম’’ কাব্যে যে ভাষা ব্যবহার করেছিলেন, এ ভাষা বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন ব্যবহার করতে পারেননি। কিন্তু মুনশী সাহেব এ ভাষা শুধু ব্যবহারই করেননি, সার্থকভাবেই তার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। তিনি নিজে সাহিত্য চর্চা করেছেন এবং ভবিষ্যতে সাহিত্য সাধনার জন্য একটি শক্তিশালী নিবেদিতচিত্ত সাহিত্য সাধক দল গঠনের কাজও আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। মুনশী সাহেবের সেই উত্তরসূরিরা হলেন ১. ইসমাইল হোসেন সিরাজী, যাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘অনল প্রবাহ'। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মুনশী সাহেবকে না দেখলেও সিরাজী সাহেবের ‘অনল প্রবাহ' তাঁর জীবনে যে দাহের সৃষ্টি করেছিল, তারই ফল ছিল তাঁর ‘অগ্নিবীণা'। ২. শেখ হাবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন ৩. কবি মুহাম্মদ গোলাম হোসেন ৪. মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন বিদ্যাবিনোদ ৫. মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ ও মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন কাব্যবিনোদ প্রমুখ। মুনশী মেহেরুল্লাহ সম্পর্কে মাওলানা আকরম খাঁ লেখেছেন : তাঁর জীবনে ও সাহিত্যে দেশপ্রেমের যে স্ফূরণ ঘটেছিল, তার মূল প্রেরণা এসেছিল কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহর কাছ থেকে। ‘‘কর্মজীবনের প্রারম্ভে স্ব-সমাজের দৈন্য-দুর্দশায় যে তীব্র অনুভূতি আমার মন ও মস্তিষ্ককে বিচলিত করিয়া তুলিয়াছিল, আপনাদেরই একজন ক্ষণজন্মা মুসলমান কর্মবীরের (মুনশী মেহেরুল্লা) সাধনা আদর্শ তাহার মূলে অনেকটা প্রেরণা যোগাইয়া দিয়াছিল। (নড়ছিলে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ কংগ্রেসের সভায় সভাপতিরূপে মাওলানার প্রদত্ত ভাষণ।)
মুনশী মেহেরুল্লাহ সম্পর্কে তাঁর অন্তরঙ্গ সহচর মুনশী শেখ জমিরুদ্দীনের মন্তব্য হলো, ‘‘যিনি বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে সভাসমিতি অধিবেশনের সূত্রপাত করিয়াছেন, যিনি খৃস্টীয় ধর্মসংক্রান্ত পুস্তকাদি লিখিয়া পাদ্রী ও খৃস্টানদিগের বিষদন্ত ভগ্ন করিয়াছেন, যিনি ইসলাম ধর্ম ও সমাজের উন্নতির জন্য জীবনোৎসর্গ করিয়াছেন, সেই মুসলিম মূল রত্ন, বাগ্নী মুলতিলক মুনশী মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ সাহেব।’’
মুনশী মেহেরুল্লাহর নিজ বাড়ি ছিল যশোর জেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামে। স্থানটি বর্তমান যশোর ঝিনাইদা প্রাচীন রেলরাস্তার পাশে (পাঁচ ছয় মাইলের কাছে) চুড়ামনকাঠি নামক রেল স্টেশনের সন্নিকটে অবস্থিত। ১৯৪৯ খৃস্টাব্দের পাকিস্তান আমলে স্টেশনটির নামকরণ করা হয় মেহেরুল্লাহ নগর। মুনশী মেহেরুল্লার পূর্বপুরুষরা খাঁ উপাধিধারী ছিলেন। যেমন তাঁর কুরসী বা বংশলতিকায় দেখা যায়, তাঁর পিতার নাম ওয়ারিস উদ্দীন, তদীয় পিতা নাসির মামুদ, তদীয় পিতা শাহ মামুদ খাঁ, তদীয় পিতা আকেল মামুদ খাঁ, তদীয় পিতা দুলায়েব খাঁ, তদীয় পিতা মুনায়েম খাঁ (মনু খাঁ) মুনশী সাহেবের পিতা একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর পাঁচ বছর বয়সের সময় পিতৃবিয়োগ ঘটে। ঐ বছরই তাঁকে পাঠশালায় ভর্তি করা হয়। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি তৎকালীন বর্ণ পরিচয় শেষ করে ফেলেন। স্বামীর মৃত্যুতে মেহের জননী চারি দিক অন্ধকার দেখতে লাগলেন। জীবনের সকল আশা-ভরসার স্থল শিশুপুত্রকে বুকে নিয়ে তিনি কষ্টে দিনযাপন করতে লাগলেন।
মুনশী মেহেরুল্লাহ প্রায় চৌদ্দ বছর বয়সের সময় লেখাপড়া শিক্ষার উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেন। তিনি কয়ালখালি গ্রামের মওলভী মোনহাব উদ্দীন সাহেবের কাছে তিন বছর বিদ্যা শিক্ষা করেন। তারপর তিনি করটিয়ার মুহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের কাছে আরবি, উর্দু ও ফারসী শিক্ষা করেন। বলাবাহুল্য, জীবনের প্রথম দিকের এই ফারসী ও উর্দু শিক্ষা তাঁর প্রচারক জীবনে বিরাট কাজে আসে। মুনশী মেহেরুল্লাহর জ্ঞানস্পৃহা ছিল অতি অদম্য। তিনি অযথা সময় নষ্ট না করে পড়াশোনায় কাটাতেন। দরজি দোকানে শিক্ষানবিশীকালেও তিনি অবসর সময় তাজ মামুদের নিকট উর্দু পড়তেন ও উর্দু সাহিত্যের চর্চার আসরে উপস্থিত হতেন। সাহিত্যামোদী অনেকে দর্জি দোকানের এই সাহিত্য চর্চার আসরে উপস্থিত হতেন। ইরানের অমর কবি শেখ সাদীর গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ কিতাবদ্বয়ের কবিতা-গল্প তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। কুরআন-হাদিসের জ্ঞানেও তিনি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তাঁর গলার সুর ছিল মধুর। তাঁর সুললিত কণ্ঠের ফারসী বয়াত সভা-সমিতির শ্রোতাদেরকে অভিভূত করে ফেলত।
জ্ঞান আহরণের উৎসাহ-বাসনা থাকলে অর্থাভাবের মধ্য দিয়েও বহু লোকের জ্ঞানীগুণী ও বড় হবার নজির পৃথিবীতে রয়েছে। দারিদ্রে্যর দুঃসহ বাধার প্রাচীর তাদেরকে জ্ঞানসাধনা ও জীবনে বড় হবার সংকল্প থেকে দূরে সরাতে পারেনি। তেমনি দারিদ্রে্যর অক্ষমতা ও কষাঘাত অনেক প্রতিভাধর ছাত্রছাত্রীর জীবনপুকে বিকশিত হবার আগেই এ পথ থেকে যে সরে যেতে বাধ্য করে, সে বাস্তবতাও অস্বীকার করার মতো নয়। মুনশী মেহেরুল্লাহ যৌবন-সীমায় পদার্পন করলে তাঁর ওপরও সংসারের চাপ এত বেশি বৃদ্ধি পায় যে, তাঁর পক্ষে ছাত্রজীবনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হলো না। রুজি-রোজগারের অন্বেষণে তাঁকে বের হতে হলো। প্রথমে একটি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড অফিসে একটি ছোটখাটো চাকরি নিলেন। কিন্তু চাকরি জীবনের বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে তিনি থাকতে পারলেন না। মুক্ত বিহঙ্গকে খাঁচায় রাখা যায় না। মুনশী মোহেরুল্লাহ স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের উপযোগী কোনো পেশায় নিয়োজিত হবার চিন্তা করলেন। খোঁজার হাটে একটি দরজি দোকানে সেলাই কাজ শিখতে লাগলেন। এ সাথে তিনি পড়ার কাজও অব্যাহত রাখেন। এ সময়ই তিনি উর্দু, ফারসী শেখেন যা পূর্বে বলা হয়েছে। এ সময় উর্দু সাহিত্য, আরবি-ফারসী বিষয়ক জ্ঞানের চর্চার মধ্যে দিয়ে তিনি ইসলামী কৃষ্টি-সংস্কৃতি, তাহজিব-তমদ্দুন সম্পর্কে যে নতুন জ্ঞান ও ধারণা লাভ করেন, তাঁর উজ্জ্বল কর্মজীবনে এটি বিরাট পাথেয়স্বরূপ কাজ করে। দরজির কাজ আয়ত্তে এনে মুনশী সাহেব যশোর শহরের দড়াটানা রোডে নিজেই একটি দোকান খুলে বসলেন। তাঁর সুমধুর ও অমায়িক ব্যবহারে শহরের অনেক বিশিষ্ট লোক এসে তাঁর কাছে বসতেন। খোদ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও তাঁর দোকানের একজন খরিদ্দার ছিলেন।
ঠিক ঐ সময়ে খৃস্টানরা বাংলার সর্বত্র ব্যাপকভাবে খৃস্ট ধর্মের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। শহর, বন্দর, গ্রাম, গঞ্জ, হাটবাজার সর্বত্রই প্রাদ্রীরা খৃস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে বেড়াচ্ছিল এবং এ দেশের মুসলমানদের ধর্মচ্যুত করছিল। তারা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা প্রচারণা চালাতো এবং সাধারণ লোকদের বিভ্রান্ত করত। মুন্সী মেহেরুল্লাহর দোকানের সামনেও রাস্তার ওপর পাদ্রীরা এভাবে বক্তৃতা দিচ্ছিল এবং ইসলামকে মানুষের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা কাহিনী এবং কুরআন শরীফের অপব্যাখ্যা করতে শুরু করল। মুনশী মেহেরুল্লাহ তাদের এ প্রেরণা দেখে এবং ‘সুসমাচার' নামে একটি বই প্রচার করতে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। কারণ, এ বইটি সরলপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করছিল। তিনি মিশনারীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দানের জন্য প্রস্তুত হলেন এবং ‘মনসুরে মুহাম্মদী' নামক একখানা উর্দু পত্রিকার গ্রাহক হলেন। এ পত্রিকা পাঠে তাঁর জ্ঞানপরিধি অনেক বৃদ্ধি পায়। তিনি প্রথমে খৃস্টান পাদ্রী-পুরোহিতদের প্রচার পত্রিকা ও বাইবেলের অনুবাদগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। ইতোমধ্যে তাঁর হাতে দু'খানা বই এসে গেল। এর একখানা হাফেজ নিয়ামতুল্লাহ রচিত ‘খৃস্টান ধর্মের ভ্রষ্টতা' আর অপরটি পাদ্রী ইশানচন্দ্র ওরফে মুনশী মুহাম্মদ এহসান উল্লাহ রচিত ‘ইঞ্জিলেও হযরত মুহাম্মদের খবর আছে'। মুনশী মেহেরুল্লাহ পাদ্রীদের সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে লাগলেন। যেখানে খৃস্টান পাদ্রীরা তাদের ধর্ম প্রচার করতেন, সেখানেই তিনি ঈমানী চেতনা নিয়ে ছুটে যেতেন। জনসাধারণ হাটে-বাজারে, সভা-সমাবেশে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের সৃষ্টি করতো। খৃস্টান পাদ্রীরা অবস্থা বেগতিক দেখে অনেক এলাকা থেকে চলে যায়। এভাবে মুনশী সাহেবের নাম দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় জনসভায় বক্তৃতাদানের জন্য তার কাছে দাওয়াত আসতে থাকে। তিনি অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে এসব দাওয়াতে সাড়া দিতেন এবং জনগণের মধ্যে ধর্মীয় চেতনার সৃষ্টি করতে লাগলেন।
যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দার্লিজিং বদলি হয়ে গেলে তাঁর অনুরোধে মুনশী সাহেবও সেখানে গেলেন এবং একটি দর্জি দোকান খুললেন। এখানে এসেও তিনি জ্ঞানচর্চায় প্রবৃত্ত হলেন। দার্জিলিংয়ে তিনি বিভিন্ন ধর্মের গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করেন। বেদ উপনিষদ, বাইবেল, ত্রিপিটক, গ্রন্থ সাহেব, গীতা প্রভৃতি তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন ‘তোহফাতুল-মোবতাদী' নামক একখানা উর্দু গ্রন্থ পাঠে তিনি বৈদিক ধর্মের অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি অবহিত হন। তিনি মিশর থেকে সোলায়মান ওয়াসী লিখিত ‘কেন আমি পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করেছিলাম' ‘কেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হয়েছিলাম' ‘প্রকৃত সত্য কোথায়?' এ তিনখানা গ্রন্থ সংগ্রহ করার পর খৃস্ট ধর্মের সাথে মোকাবেলা করার জন্য তাকে আর কোন চিন্তা করতে হলো না। এখন তিনি আর দর্জির দোকানে আবদ্ধ থাকতে চান না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি আপত্তি করলেন না। এরপর থেকে মুনশী মেহেরুল্লাহ খৃস্টান মিশনারীদের কাজের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
মেহেরুল্লাহ এখন পুরোপুরি ইসলামের কাজে নিয়োজিত। তিনি তৎকালীন মুসলিম সমাজসেবকদের সাথে যোগাযোগ করবেন। কলকাতা গিয়ে ‘মিহির' পত্রিকার সম্পাদক মুনশী রেয়াজুদ্দীন আহমদ, ‘সুধাকর' সম্পাদক মুনশী আবদুর রহিম, মুনশী মেয়ারাজুদ্দীন আহমদ, পন্ডিত রিয়াজুদ্দীন মাশহাদী প্রমুখের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। কলকাতা নাখোদা মসজিদে একটি সভার আয়োজন করেন। এ সভার আয়োজনে খান বাহাদুর বদরুদ্দীন হায়দার, খানবাহাদুর নূর মুহাম্মদ জাকরিয়া প্রমুখ চিন্তাবিদ সহায়তা করেছেন। সভায় ‘নিখিল ভারত ইসলাম সমিতি' নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা-আসামে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মুনশী মেহেরুল্লাহর ওপরে। সর্বত্র তাঁর সাথে খৃস্টান পাদ্রীদের বহাস হতে থাকে। কিন্তু সর্বত্রই এই যুক্তিবাদী বক্তার কাছে পাদ্রীরা হার মানতে লাগলেন। ‘খৃস্টান বান্ধব' নামে মিশনারীদের একটি প্রচারপত্র ছিল। এতে খৃস্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে জন জমিরুদ্দীন ১৮৯২ সালে ‘আসল কুরআন কোথায়' এ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধে বলা হয়, ‘হযরত মুহাম্মদের প্রচারিত কোরআনের সাথে আসল কোরআনের মিল নেই।' মুনশী মেহেরুল্লাহ সুধাকর পত্রিকায় তার জবাবে লিখলেন ‘খৃস্টানী ধোঁকা ভঞ্জন।' জন জমিরুদ্দীন এর কোনো জবাব দিতে পারলেন না, বরং এতে নতুন জ্ঞানের সন্ধান পেয়ে মুনশী সাহেবের কাছে ছুটে গেলেন এবং পুনরায় মুসলমান হয়ে গেলেন।
মুনশী মেহেরুল্লাহ খৃস্টান মিশনারীদের দ্বারা বাংলা আসামের মুসলমানদের ধর্মান্তর রোধে ঝাঁপিয়ে না পড়লে এ দেশে হয়তো আজ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা টিকে থাকতো না। এদিক থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সহজেই অনুমেয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে একই ফিতনা আবার দেখা দিয়েছে। কিন্তু দেশের ওলামা-মাশায়েখের সেই তুলনায় যা করার দরকার ছিল, তা হচ্ছে না। ফলে অনেকে আশঙ্কা করছেন যে, না জানি বাংলাদেশ একদিন লেবাননে পরিণত হয়। মুনশী মেহেরুল্লাহ ১৯০৭ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৪ বাংলা রোজ শুক্রবার ১টার সময় ৪৬ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
তথ্যসূত্র: দৈনিক সংগ্রাম