
Home দৃষ্টিপাত (Visibility) > কপোতাক্ষ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে সোচ্চার হোউন
এই পৃষ্ঠাটি মোট 84567 বার পড়া হয়েছে
কপোতাক্ষ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে সোচ্চার হোউন
কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন কমিটির উদ্যোগে যশোরের ঝিকরগাছার পারবাজার থেকে যশোর শহরের চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হয়। পদযাত্রায় কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী ছয়টি উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেয়।
সকাল ১০টায় ঝিকরগাছার পারবাজারে পদযাত্রার উদ্বোধন করেন তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহবায়ক শহিদুল্লাহ। সমাবেশ শেষে দুপুর ১২টার দিকে পদযাত্রা শুরু হয়। তিন ঘন্টা হাটার পর সামাবেশটি বেলা তিনটার দিকে শহরের চৌরাস্তা মোড়ে এসে পৌঁছায়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ, আহবায়ক অনিল বিশ্বাস, আইনজীবী আবু বকর সিদ্দিকী প্রমুখ। সমাবেশে বক্তারা বলেন, উজানে পদ্মা, মাথাভাঙ্গা ও ভৈরব নদের সঙ্গে সংযোগ না দিলে কপোতাক্ষ বাঁচানের জন্য কোন প্রকল্পই বাস্তবায়ন হবে না। ভূল পরিকল্পনার কারণে এরই মধ্যে ২৬ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক টাউট, ঠিকাদার, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও পানিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা প্রকল্পের টাকা লুটপাট করেছেন, যার জন্য কপোতাক্ষ তীরের কোটি মানুষ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। পদযাত্রার ছবি
কপোতাক্ষ নদ সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে ! সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে; সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে শোনে মায়া - মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে ! বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে ? দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে। আর কি হে হবে দেখা ? - যত দিন যাবে, প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে বারি- রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে বঙ্গজ জনের কানে, সখে, সখা-রীতে নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে লইছে যে তব নাম বঙ্গের সংগীতে। |
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতি জড়ানো কপোতাক্ষ নদ এখন হুমকির মুখে। বছরের ৬ মাসই নদের পারের মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার। এ সমস্যা মেটাতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এসব প্রচেষ্টার সবগুলোই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- মাত্র ২৫ কিলোমিটার খননের মাধ্যমে কপোতাক্ষের সেই যৌবন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। দু’পারের মানুষও মুক্ত হতে পারে জলাবদ্ধতা থেকে।
জনগণের ধারাবাহিক আন্দোলনের চাপে সরকার কপোতাক্ষ খননের জন্য ২৬১ কোটি ৫৪ লক্ষ ৮৩ হাজার টাকার একটি প্রকল্প বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু এই টাকা যে ঠিকভাবে ব্যয়িত হবে- তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। উজানে মাথাভাঙ্গা নদীর মাধ্যমে পদ্মার সাথে কপোতাক্ষে- ভৈরবের সংযোগের ব্যবস্থা না রেখে, কেবলমাত্র ভাটিতে সাতক্ষীরা অংশে পলি অপসারণের জন্য একটি খন্ডিত প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও কপোতাক্ষে উজানের প্রবাহ যুক্ত হবে না এবং সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। বার বার পলি অপসারণ করা হবে, বার বার জোয়ারে উঠে আসা পলিতে পুনরায় কপোতাক্ষ খাত ভরাট হয়ে যাবে। তাই জনগণের কাছে এ প্রকল্প গ্রহণযোগ্য নয়। এতদিন জনগণ একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের নদী ও পানি সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে কপোতাক্ষসহ পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নদী সংস্কারের যে দাবি করে এসেছেন, বর্তমান প্রকল্পে সে দাবি পূরণ হয় নি। কনসালট্যান্সি গ্রুপ সিইজিআইএস ও আইডব্লিউএমকে দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে প্রকল্পটি বানিয়ে নিয়েছে তা খন্ডিত, অসম্পূর্ণ ও অনুপযোগী এবং তা বাস্তবসম্মত নয়। সরকারের উচিত সমস্যার মোলক সমাধানের লক্ষ্যে ক্সাল্ট্যান্টদের কাছে একটি সামগ্রিক পরামর্শ চাওয়া; তা না করে, A project for Sustainable Drainage of Kobaduk Basin under Jessore-Satkhira Distkrict এই শিরোনামায় তাদের কাছে কপোতাক্ষের একটি সীমিত অংশ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় সাময়িক সমাধানের জন্য।
সিইজিআইএস ইতিপূর্বে একাধিকবার কপোতাক্ষ নদে ইঞ্জিনিয়ারিং মডেল বানিয়ে দিয়েছে; এবং প্রতিবারই তা ফেল করেছে। এই সব ইঞ্জিনিয়ারিং মডেলের অনুসঙ্গ হিসেবে প্রতিবারই নদীখাতে আড়বাঁধ (encloser) দেওয়া হয়। প্রতিবারই দেখা যায়, বাঁধের নিচের অংশ পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। দেখা যায়, প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পর আগের চেয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তা ছাড়া পাউবো এ পর্যন্ত নদীখাত থেকে একটি বাঁধও তোলার প্রয়োজন বোধ করে নি। প্রকল্পবাস্তবায়নের পর এর সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন হয়েছে বলেও শোনা যায় না। তাই পাউবোর ধারাবাহিক অপকর্মের জন্যই কপোতাক্ষ অববাহিকার জনজীবনে আজকের এ মহাদুর্ভোগ নেমে এসেছে। ২০০৪ সনের খননের পর সরসকাটি ব্রিজের উজানে ১১ কিলোমিটারের একটি অসম্পূর্ণ অংশ খনন করার সময় ২০০৫ সালে সরসকাটি ব্রিজের নিচে পুনরায় বাঁধ দেওয়া হয়; ফলে ভাটিতে ৪৫ কিমি খনন-করা অংশসহ আরও বিপুল এলাকা পলিভরাট হয়ে যায়। সেই সময় আন্দোলন কমিটি ও এলাকার গণপ্রতিনিধিগণ পাউবোর এ কাজের তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছিলেন। ২০০১ সনে তৈরি পাঁজাখোলার বাঁধ তুলে দেওয়ার জন্যও ২০০৫ সনে জনগণ তীব্র আন্দোলন করেন; কিন্তু সরকার এসব প্রতিবাদ ভ্রম্নক্ষেপ করেনি; ফলে যা হবার তা হয়ে গেছে এবং জনগণকে তাই আজ মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
বিগত সরকারের আমলে কপোতাক্ষ খননকালে জনগণকে তিনটি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল :
১) খনন কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হবে; ২) কপোতাক্ষ নদে স্থায়ীভাবে একটি ড্রেজার রেখে দেওয়া হবে এবং ৩) কাজ মনিটরিং এর জন্য প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে আন্দোলনের কমিটিকে রাখা হবে। সে প্রতিশ্রুতি মানা হয়নি। ২০০৩ সন থেকে কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন অন্যান্য দাবির সাথে ২টি দাবির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসেছে; তা হলো (১) একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে কপোতাক্ষকে উজানে মাথাভাঙ্গা নদীখাত বরাবর পদ্মার সাথে সংযোগ দিতে হবে এবং (২) অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রথমে কপোতাক্ষ এবং পর্যায়ক্রমে এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলি সংস্কার করতে হবে। ২০০৮ সনের মার্চ মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন কমিটি একটি ধারনাপত্রসহ নদ-সংস্কারের প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিল। এখন লক্ষ্য করা যায়, সে প্রস্তাবনার একটি অংশগ্রহণ করা হলেও উজানে পদ্মার সাথে সংযোগের দাবিটি বেমালুম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উজানের প্রবাহ যুক্ত করা ছাড়া ভাটির অংশে পলি অপসারণ করে নদীকে স্থায়ীভাবে রক্ষা করা যাবে না।
উক্ত ধারনাপত্রে অন্যান্য সুবিধাগুলির কথাও বলা ছিল, যেমন, (১) গোয়ালন্দের উজানে কুষ্টিয়ায় ভারতসীমানা পর্যন্ত নদীগুলি খনন করা হলে একই সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার অবসান হবে, (২) সুন্দরবনের উন্নতি হবে, (৩) এ অঞ্চলের পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যের উন্নতি হবে; এবং (৪) সেই সাথে দেশের নিম্ন-মধ্য অঞ্চলের বন্যার চাপ কমতে থাকবে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশবিজ্ঞানী যাঁরা বাংলাদেশে কাজ করেছেন, তাঁদের বক্তব্যের সাথে আমাদের প্রসত্মাবনায় মিল রয়েছে। এ পর্যন্ত কোন সরকারের আমলেই বিজ্ঞানীদের স্বাধীন মতামতকে আমলে নেওয়া হয়নি। আরও উল্লেখ্য, ১৯৫৪ সনে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো ক্রুগমিশন কর্তৃক প্রণীত যে পানি-নীতি পাকিস্তান সরকার গ্রহণ করেছিল, সেই একই নীতির পুনর্বাসন করা হচ্ছে বারবার শুধু নাম পাল্টিয়ে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, একের পর এক সরকার পাল্টাচ্ছে; কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও এডিবির চাপের কাছে নতি স্বীকার করার কারণে স্বাধীন পানি-নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে না। বিদ্যমান পানি-নীতির লক্ষ্যই হলো নদীকে জনপদ জনজীবনের ধাত্রী হিসেবে না মেনে, নদীর তীর বরাবর সমান্তরাল বাঁধ, সুইসগেট, এনক্লোজার ও কর্ডন দিয়ে নদীকে শত্রুর পর্যায়ে ভেবে জনপদ জনীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।
কপোতাক্ষ, বেতনা, শালিখা ও মরিচ্চা অববাহিকায় আজকে যে স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে, তার সমাধানের জন্য একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথমে কপোতাক্ষ ও পর্যায়ক্রমে ভৈরবসহ অন্যান্য নদীখাত খনন করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। এ অঞ্চলের জন্য উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগ নদী খননকাজে লাগাতে হবে। নদ-নদী বাঁচলে এলাকার পরিবেশের উন্নতি হবে; তখন যে কোন উন্নয়ন কাজ একটি স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা পাবে। নদী না বাঁচলে সব উন্নয়ন কজে পানিতে ডুবে যাবে।
আসুন, কপোতাক্ষের ভাটির অংশে যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার সাথে এখনই উজানে নদীসংযোগের দাবিটি উর্ধে তুলে ধরে শক্তিশালী জনমত ও গণআন্দোলন গড়ে তুলি।
শুভেচ্ছান্তে
(অনিল বিশ্বাস)
আহ্বায়ক
কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন
সমন্বয় কমিটি
নীলরতন ধর, রোড, যশোর।
যোগাযোগ : ০১১৯৮-২০৮০৬৮, ০১৭১২-৫৬১৮৯৮