
Home কৃষি ও শিল্প (Agriculture and Industry) > চাঁচড়া বাসীর রূপালী বিল্পব
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86162 বার পড়া হয়েছে
চাঁচড়া বাসীর রূপালী বিল্পব
সরকারী কোন সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই যশোরের চাঁচড়া গ্রামের মানুষ মাছের পোনা উৎপাদনে এক নীরব বিল্পব সংঘটিত করেছেন। চাঁচড়া ছাড়াও আশেপাশের এলাকায় ৫০টি হ্যাচারী আর প্রায় ১ হাজার নার্সারি প্রতিষ্ঠা করে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকা মূল্যের রেণু পোনা উৎপাদন করছেন এ এলাকার মৎস ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন স্থানীয় বাজারে ৫০ লাখ টাকার পোনা বিক্রী হচ্ছে। দেশের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ পোনা উৎপাদন করে এলাকাবাসী নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি আমিষের ঘাটতি পূরণে আনুসরণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছেন। এখানে উৎপাদিত ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার পোনা প্রতিদিন পার্শ্ববর্তী দেশে চালান হয়ে যাওয়া মাছ চাষে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ১ লাখ মানুষ এ পেশায় যুক্ত হয়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙ্গাস, মাগুর, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, মিনার কার্প, রালক কার্প, মিরর কার্পসহ অন্যান্য সাদা মাছের রেণু পোনা উৎপাদন করে চাঁচড়া গ্রামের চেহারা বদলে ফেলেছে।
কিন্তু এই পোনা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত লাখো লাখো মানুষের কোনো দাবিই বাস্তবায়িত হয়নি। মৎস পল্লী গড়ে তোলা, ব্রুড ব্যাংক (পোনা ব্যাংক) প্রতিষ্ঠা করা, আধুনিক মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণ করা, আধুনিক পোনার বাজার স্থাপন করা-এই দাবিগুলোর একটিও বাস্তবয়িত না হওয়ায় পোনা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা হতাশ।
চাঁচড়া মানেই মৎসপল্লী :
যশোর শহরের দক্ষিণ দিকে চাঁচড়া এলাকা। বিরাট গ্রাম। পৌরসভা আর ইউনিয়ন নিয়ে এই গ্রাম গঠিত। স্টেশনের পর থেকে চাঁচড়া গ্রাম শুরু। ৪ কিলোমিটার পর দক্ষিণ পূর্বের রাজবংশীতে (বর্মণপাড়ার) গিয়ে এ গ্রামের শেষ। কয়েক বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ গ্রামে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করে। ইতিহাস বিখ্যাত চাঁচড়া রাশবংশের ধ্বংশপ্রাপ্ত রাজবাড়ী এ এলাকা হতে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে আবস্থান করছে।
কাক ডাকা ভেরেই চাঁচড়া জেগে ওঠে। যশোর-বেনাপোল সড়কের ডালমিলের কাছে দেখা যায় পাকা সড়কের দুই ধারে বিরাট বিরাট এলুমিনিয়ামের হাঁডি নিয়ে মাগুর পোনা বিক্রী করছেন শত শত মানুষ। পাশাপাশি চাঁচড়া মোড়, কামারখালি মোড়, পাওয়ার হাউস এলাকায় ‘হাকা’য় (এক ধরনের জাল) বিক্রী হচ্ছে সাদা মাছের পোনা। ভোরের আলোয় ছোট ছোট রুই-কাতলার ঝাঁক রূপার মতো চকচক করছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত মানুষ এই পোনা কিনতে আসেন। কোটি কোটি পোনা কেনাবেচা হচ্ছে। বাস, ট্রাক, পিকআপ বোঝাই হয়ে সে মাছ চলে যাচ্ছে ঢাকা, বরিশাল, সিলেট, ফরিদপুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায়। জাল, মাছের খাবার, ব্যারেল ভর্তি পোনা নিয়ে ছুটছে এলাকার সব ব্যস্ত মানুষ। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত এলাকার সর্বত্র একই দৃশ্য চোখে পড়ে।
কবে থেকে শুরু :
প্রায় ২০০ বছর আগে চাঁচড়ায় এই মাছ উৎপাদন শুরু করেন স্থানীয় রাজা সতীশ চন্দ্র। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রাজার প্রিয় মাছ ছিল পাবদা। আর চাঁচড়ার বর্মণপাড়ার জেলেদেরকে দিয়ে সর্বপ্রথম এই পাবদা মাছ চাষ শুরু করেন রাজা। দীর্ঘদিন পর চাঁচড়া সবজীবাগের শেখ মহসিন আলী পঞ্চাশের দশকে নদী থেকে রেণু (ডিম) সংগ্রহ করে নার্সারি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পোনা উৎপাদন শুরু করেন। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত তিনি এককভাবে পোনা উৎপাদনের কাজ করেছেন। পরবর্তীতে মাছের অব্যাহত চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এলাকার বহু মানুষ এ পেশায় যুক্ত হন।
মহসিন আলীর ছেলে শেখ বাহারউদ্দিন ১৯৮২ সালে হ্যাচারি প্রতিষ্ঠা করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছের রেণু পোনা উৎপাদন করতে সক্ষম হন। বাহউদ্দিনের প্রতিষ্ঠিত সেনালী মৎস হ্যাচারিই হচ্ছে বাংলাদেশের বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত প্রথম হ্যাচারি। বাহাউদ্দিনের সফলতা দেখে ১৯৮৩ সালে তার বড় ভাই শেখ মেজবাউদ্দিন, কারবালার শামসুল ইসলাম হ্যাচারি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর চাঁচড়ার মোস্তফা কামাল, সাইফুজ্জামান মজু, ফিরোজ খানসহ আরও অনেকে রেণু উৎপাদনের জন্য হ্যাচারি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন।
চাঁচড়ায় এখন ছোট বড় মিলিয়ে ৫৫টি হ্যাচারী রয়েছে। এ সব হ্যাচারীতে প্রায় ৫০ হাজার কেজি রুই জাতীয় সাদা মাছের ডিম (রেণু) উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে ৩০টি হ্যাচারিতে বছরে ৩০/৩৫ কেজি পাঙ্গাস মাছের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। এই সব হ্যাচারির ডিম নিয়ে প্রায় ২ হাজার নর্সারিতে মাছের পোন উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে এই ব্যবসার সাথে কমপক্ষে ১ লাখ মানুষ জড়িয়ে পড়েছে।
ডালমিল এখন মাগুর পট্টি :
চাঁচড়া ডালমিল পার হয়ে সরু যে পীচের রাস্তা চাঁচড়া মোড়ে গিয়ে মিশেছে তারই এখন নাম হয়েছে মাগুর পট্টি। রাস্তার দুধারে প্রায় ৫০০ গজ জুড়ে গড়ে উঠেছে পোনা মাগুরের বাজার। কয়েক হাজার মানুষ এই বাজারের মাছ কেনা বেচার সথে যুক্ত রয়েছেন।
সম্প্রতি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বিরাট বিরাট হাড়িতে লাখ লাখ ছোট লাল রঙের মাগুর পোনা কিলবিল করছে। কেউ ডানো দুধ, ওরস্যালাইন, টেট্রাসাইক্লিন, ক্যাপসুল পোনাকে খেতে দিচ্ছে। পোনা বিক্রেতারা স্বীকার না করলেও জানা যায়, এই পোনার বিরাট চালান প্রতিদিন ভারতে চলে যাচ্ছে। ভারতে এ মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি বলেই মাছের পোনা বৈধ-অবৈধ পথে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
১৯৯০ সালে মাগুর পোনা উৎপাদন শুরু হলেও ১৯৯২ সালে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। এখন প্রতি বছর মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘পিক সীজনে’ এই বাজারে প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা মূল্যের ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি মাগুর পোনা বিক্রি হচ্ছে। দেশের বাজার ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশে চালান হয়ে যায় এই মাছের পোনা।
পাঙ্গাস যেন আশীর্বাদ :
চাঁচড়া এলাকার হ্যাচারি মালিকরা কখনও কল্পনা করেননি রুই মাছের পাশাপাশি পাঙ্গাস মাছের ডিম উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু সেই পাঙ্গাসই হ্যাচারি মালিকদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। পাঙ্গাস মাছের রেণু উৎপাদন করে ইতোমধ্যে অনেক হ্যাচারি মালিক লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। এর বড় একটি অংশ এখন ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছে :
পুকুরে পাঙ্গাস মাছের চাষ আগে হয়নি। ১৯৯০ সালের দিকে থাইল্যান্ড থেকে পাঙ্গাসের পোনা আমদানি শুরু হয়। ১ ইঞ্চি সাইজের পোনার দাম ৫ টাকা। আবহওয়াগত কারণে বেশির ভাগ পোনা মরে যায়। এমন অবস্থায় চাঁচড়া ডালমিল এলাকার শুভ্র মৎস্য হ্যাচারির মালিক সাইফুজ্জামান মজু ও সিরাজ খান ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে এফআরআই (মৎস গবেষণ কেন্দ্র) থেকে ১২৫টি পাঙ্গাসের ‘ব্রুড ফিস’ নিয়ে আসেন। এই মাছের ডিম দিয়ে তারা অনেক চেষ্টা তদবিরের পর ১৯৯৫ সালে ১৩ হাজার পোনা উৎপাদন করতে সক্ষম হন। ১৯৯৬ সালে শুভ্র হ্যাচারিতে লাখ লাখ পোনার জন্ম হলে স্থানীয় হ্যাচারি মালিক শেখ বাহারউদ্দিন, শেখ মেজবাউদ্দিন, শামসুল ইসলামসহ আরো অনেকে পাঙ্গাসের ডিম উৎপাদনে এগিয়ে আসেন। বর্তমানে ৪০টি হ্যাচারিতে ৩০কোটি পাঙ্গাসের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। হ্যাচারি থেকেই প্রতিকেজি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার টাকায়। আর পোনা বিক্রি হচ্ছে প্রতি হাজার ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা। বাজারে পাঙ্গাস পোনার মূল্য বেশী বলে এখন অনেকেই নার্সারিতে রেণু লালন-পালন করে তা বিক্রি করছেন।
রপ্তানির ব্যবস্থা চাই :
দেশে বেসরকারি পর্যায়ে পাঙ্গাসের রেণু উৎপাদনকারী শুভ্র হ্যাচারির মালিক ফিরোজ খান ও সাইফুজ্জামান মজু পাঙ্গাসের পোনা চাষ সম্পর্কে বলেন, “আগে থাইল্যান্ড থেকে পাঙ্গাসের পোনা ডলারের বিনিময়ে আমদানী করা হতো। প্রতি কেজি ডিমে ১ লাখ পেনা উৎপাদন করা সম্ভব হয়। কিন্তু আমরা নিজেরাই গবেষণা করে এখন প্রতি কেজি ডিমে আড়াই থেকে ৩ লাখ পোনা উৎপাদন করছি”। দেশে পাঙ্গাস চাষের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। এই ব্যক্তি বলেন, “নিজেরা পাঙ্গাসের রেণু উৎপাদনের কলাকৌশল আবিষ্কার করলেও তা নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না জনস্বার্থে অন্যদেরও শিখিয়ে দিয়েছি”। তাদের দাবি হচ্ছে, এখানকার উৎপাদিত পাঙ্গাস মাছ বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা উচিত। এতে প্রকৃত হ্যাচারি মালিকদের পাশাপাশি দেশও লাভবান হবে।
সম্ভাবনা ও সমস্যার কথা :
চাঁচড়ার মৎস ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমরা যে পর্যায়ে পৌঁছেছি তাতে এখন শুধু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি এগিয়ে আসেন তাহলে দেশে মাছের পোনার চাহিদা পূরণ করে প্রচুর পোনা বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। আর এই পোনা রপ্তানির মাধ্যমে চিংড়ির মতো বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা মোটেও কঠিন নয়।
এ প্রসঙ্গে যশোর জেলা মৎস্যচাষী সমিতির সভাপতি সাইফুজ্জামান মজু বলেন, “জরুরি ভিত্তিতে পাঙ্গাস আর মাগুর পোনা রপ্তানির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে”। পোনার মান উন্নত রাখতে যশোর মৎস বিভাগের পক্ষ থেকে ব্রুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এই ব্যাংক থেকে ফ্রেশ ব্রুড ফিশ সরবরাহ করা হলে তা থেকে যে ডিম উৎপাদিত হবে তার পেনার মান উন্নত থাকবে। এ ছাড়া বাজার আধুনিকীকরণ ও স্থানীয়ভাবে মাছ বাঁচিয়ে রাখার জন্য অক্সিজেন প্লান্ট নির্মাণের দাবি জানান তিনি। শুভ্র মৎস হ্যাচারির মালিক ফিরোজ খান বলেন, চাঁচড়াকে অবিলম্বে মৎস পল্লী ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তিনি এফআরআই কেন্দ্রটি দ্রুত নির্মাণেও দাবি জানান।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এম. এ. মজিদ চাঁচড়া এলাকায় মাছ চাষের সাফল্যের কথা স্বীকার করে বলেন, মাছ চাষীদের সুবিধার্তে এলাকায় এফআরআইয়ের একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ভূমি হুকুম দখলের কারণে কেন্দ্রটি নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে। কেন্দ্রটি নির্মিত হলে মৎস চাষী ও হ্যাচারি মালিকরা টেকনিক্যাল অনেক বিষয়ে সহায়তা পাবে। চাঁচড়ার মৎস বিল্পব সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে যশোর জেলা মৎস কর্মকর্তা নিত্যনন্দ দাস বলেন, “যারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত তারাই বিষয়টি সম্পর্কে আমার চেয়ে ভালো জানেন”। এফআরআই কবে প্রতিষ্ঠিত হবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমার তা জানা নেই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন”। তিনি স্বীকার করেন, জেলার মাছ চাষের সার্বিক দেখ-ভালোর দায়িত্ব তার থাকলেও ‘বাস্তবতার কারণে’ তিনি এ ব্যাপারে সময় দিতে পারেন না।
তথ্য সূত্র :
দক্ষিণের জনপদ
লেখক : ফকরে আলম
তথ্য সরবরাহ :
আর. এম. মনজুরুল আলম টুটুল
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শেষ আপডেট :
২৭.০৩.২০১১