
Home প্রকৃতি ও পরিবেশ (Nature and Environment) > বন্যা
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100140 বার পড়া হয়েছে
বন্যা
বন্যাঃ
অতীতের এক সময় এ জেলায় প্রায়ই বন্যা হত। গত শতব্দী হইতে নদীর গতি পরিবর্তন ও নদীর তলদেশে ভরাট হতে থাকলে এ জেলায় বন্যার প্রকোপ আগের দিনের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এ জেলায় অধিকাংশ নদী পদ্মানদী হতে উৎপন্ন হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। এ জন্য পদ্মা নদীতে যতদিন প্রবাহ বেশি ছিল ততদিন এ জেলায় নদীগুলি অধিক প্রবাহমান ছিল। পদ্মা নদীতে পানি বেশি হলেই যশোর জেলার নদীগুলিতে পানি বৃদ্ধি পেত এবং প্রায়ই নদীর কূল উপচে পার্শ্ববর্তী এলাকায় বন্যা দেখা যেত। গত শতাব্দীতে কুমার ও নবগঙ্গা মধ্যবর্তী অববাহিকায় কায়েকটি ভয়ংকরী বন্যা সংঘটিত হয়। বর্তমানে কুমার ও নবগঙ্গা নদী পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে এ ধরণের বন্যা আর দেখা যাচ্ছে না। জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশে এখনও পলি সঞ্চয় হয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রতিবছর কিছু কিছু ভূমি বন্যা সীমানার উপরে চলে আসে। পদ্মায় পানি অত্যাধিক বৃদ্ধি পেলে কুমার নদীতে এখনও বন্যা হয়। নিম্নে এ জেলার উল্লেখযোগ্য বন্যা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করা হলঃ-
বন্যা-১৭৮৭, ১৭৯০ ও ১৭৯৮:
অষ্টদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় বেশ কয়েকটি বড় ধরণের বন্যা এ জেলায় সংঘটিত হয়। স্যার জেমস্ ওয়েস্টল্যান্ড তাঁর A Report on Jessore- এ উল্লেখ করেন যে ১৭৪৭ সালে এ জেলায় ধ্বংসকারী বন্যা সংঘটিত হয় এবং সেই সংগে ঐ এলাকার উপর দিয়ে একটি ঘূর্ণীঝড় বয়ে যায়। এই বন্যায় জেলার মুহাম্মদ শাহ নামক বাঁধটি বন্যার পানির তোড়ে ভেঙ্গে যায়। জেলায় ১৭৯৮ থেকে ১৮০১ সালের মধ্যে কায়েকটি বন্যা সংঘটিত হয়। এসব বন্যায় জেলার ফসলের প্রচুর ক্ষতি হয় এবং অনেক গবাদি পশু মারা যায়। এসব বন্যাগুলির মধ্যে ১৭৯৮ সালের বন্যাতে জেলার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঐ সময় মানুষ খাদ্যাভাবে কষ্ট পায় এবং খাদ্যের জন্য জেলা কর্তৃপক্ষের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
বন্যা-১৮৩৮, ১৮৪৭, ১৮৫৭ এবং ১৮৭১:
যশোর জেলার বন্যাগুলির মধ্যে ১৮৩৮, ১৮৫৬ এবং ১৮৭১ সালের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৮৩৮ সালের বন্যায় জেলার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৮৭১ সালের বন্যায় জেলার অধিকাংশ এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে যায়। বন্যার সময় এ জেলার প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে বন্যার প্রকোপ আরো বেড়ে যায়। মানুষ কষ্ট এবং ফসল ও গবাদি পশুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।
বন্যা-১৮৮৫:
উনবিংশ শতাব্দির শেষদিকে যশোর জেলার যেসব বন্যা দেখা যায় তার মধ্যে ১৮৮৫ সালের বন্যা এবং ১৮৯০ সালের বন্য উল্লেখযোগ্য। ১৮৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেলায় একটি বড় ধরনের বন্যা হয়। এ বছর সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে জেলার জলাঙ্গি নদীর পানি ২৯ ফিট বৃদ্ধি পায় এবং এতে যশোর জেলারয় পশ্চিমাংশ প্লাবিত হয়। এ সময় গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে পানি বৃদ্ধি পায় কিন্তু গোয়ালন্দের নিকট পদ্মা নদীতে পলি জমে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহে বাঁধার সৃষ্টি হলে ঐ পানি কুষ্টিয়া জেলার অর্ধেক অংশ পাঁচ ফিট পনির নিচে চলে যায়। এ সময় জেলার তিন স্থানে রেল সড়ক পানির নিচে চলে যায়। রেলের পরিবর্তে লঞ্চের মাধ্যমে ডাক পরিবহণ করা হয়। অথচ কয়েকদিন আগেও ঐসব স্থান শুষ্ক ও ধানক্ষেতে পরিপূর্ণ ছিল। এ বন্যায় যশোর জেলার প্রায় ৪০০ বর্গমাইল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রচুর ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এ বন্যায় মাগুরার ও নড়াইলের শীতকালীন ফসলের আংশিক এবং আউশ ধানের অধিকাংশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে যশোর সদরে প্রায় সব আমন ধানই এ বন্যায় ডুবে যায়।
বন্যা- ১৮৯০:
১৮৮৫ সালের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আগেই ১৮৯০ সালের শরৎকালে এ জেলায় পুনরায় একটি বড় বন্যা সংঘটিত হয়। এ বন্যায় জেলার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৮৯০ সালে কুষ্টিয়া জেলার নদীতে ১৮৮৫ সালের তবন্যার পানির তুলনায় আরো প্রায় একফুট পানি বেশি বৃদ্ধি পায়। এ বন্যায় যশোর জেলার তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমা এবং সদর মহকুমা সর্বাপেক্ষা বেশি কষতিগ্রস্ত হয়। ইছামতি, নবগঙ্গা ও বেতনা নদীর অতিরিক্ত পানির চাপে এ অঞ্চলে এ বন্যা সংঘটিত হয়। এ বন্যায় জেলর আমন ও আউশ ধানের অর্ধেক নষ্ট হয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ত্রাণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। ঐ সময় যেসব সরকারী সাহায্য দেওয়া হয় সেগলি ছিল: (১) কৃষিঋণ (২) নৌকা, গবাদি পশু ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের ঋণ (৩) ত্রাণ সাহায্য এবং (৪) ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ড কর্তৃক কাজের বিনিময়ে সাহায্য।
বন্যা- ১৯৬৮:
এ বছর বন্যায় যশোর জেলার ২০টি থানার মধ্যে ১৩টি থানা বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। আখ, পাট, আমন ও আউশ ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয় এ বন্যায়। এ বন্যায় ঝিনাইদহের ৫০% ফসল এবং ১৫% কাঁচা বাড়ীর সম্পূর্ণ অথবা আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এ বন্যায় মানুষের কোন জীবনহানি না ঘটলেও বেশ কিছু গবাদি পশুর মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়।
বন্যা- ১৯৭০:
অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের কারণে ১৯৭০ সালে যশোর জেলার কোতয়ালী, কেশবপুর, শার্শা, ঝিকরগাছা, মনিরামপুর, অভয়নগর, বাঘেরপাড়া, মহেশপুর, কালিগঞ্জ এবং কোটচাঁদপুর থানায় বন্যা হয়। এ বন্যায় তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমার ৫০% আমন ও আউশ ধান নষ্ট হয়ে যায়। কোতয়ালি থানার হরিপুর বিলটি এ সমতয় সম্পূর্ণরূপে বন্যার পানির নিচে চলে যায়। এ বন্যায় তৎকালীন যশোর সদর মহকুমার ১৩ লক্ষ ১৬ হাজার টন খাদ্যশস্য এবং ঝিনাইদহ মহকুমার অসংখ্য নলকূপ এবং ২০,০০০ কাঁচা বাড়ী ধ্বংস হয়। তৎকালীন সরকার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য ঐ জেলায় ২০ হাজার মন গম, ১৫ হাজার নগদ টাকা, ৫০ হাজার নগদ টাকা বাড়ী তৈরী বাবদ এবং বিবিধ খরচ বাবদ ২০,০০০ টাকা বিতরণ করে।
বন্যা- ১৯৮৮:
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে স্মরণকালের ভয়াবহতম বন্যা ঘটে যায়। এ বন্যায় দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। এ ভয়াবহ বন্যা যশোর জেলাকে বন্যা কবলিত করেনি। তবে প্রত্যক্ষভাবে এ জেলা এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের বন্যা কবলিত প্রচুর লোকজন এ জেলায় আশ্রয় গ্রহণ করে।
সূত্র: যশোর গেজেটিয়ার