
Home ডিজিটাল যশোর (Digital Jessore) > ডিজিটাল আলোয় আলোকিত যশোর
এই পৃষ্ঠাটি মোট 89505 বার পড়া হয়েছে
ডিজিটাল আলোয় আলোকিত যশোর
দেশের প্রথম 'ডিজিটাল জেলা' হিসেবে যশোরে অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট, ই-মনিটরিং, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ইউসিসের মাধ্যমে পর্চা

'এক ক্লিকেই সেবা' স্লোগান নিয়ে গড়ে উঠছে ডিজিটাল যশোর। তথ্যপ্রযুক্তি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১ সালে যশোর জেলা প্রশাসন 'ই-এশিয়া অ্যাওয়ার্ড' লাভ করেছে।
ই-মনিটরিং
এক হাজার ২৪৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে যশোর জেলায়। এগুলোতে নজরদারি বাড়াতে ই-মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সব স্কুলের ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা হচ্ছে। এখান থেকেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর উপস্থিতি সম্পর্কে জানা যাবে। ফলে শিক্ষার মান বাড়বে। বৃত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও এই প্রযুক্তি কাজে আসবে।
ই-কমার্স
জেলায় উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য বাজারজাত করতে ব্যবসায়ী, উৎপাদক ও ক্রেতাদের জন্য 'আমাদের বাজার' নামের একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে ই-কমার্স চালু করা হয়েছে। এই সাইটে পণ্যের সব ধরনের তথ্য রয়েছে। জেলার মধ্যে 'হোম ডেলিভারি'রও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। জেলার বাইরের ক্রেতাকে পণ্যের মূল্য পরিশোধে প্রিপেইড অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এর মাধ্যমে ওই পণ্যের মূল্য পরিশোধের পাশাপাশি ক্রেতা অনলাইনে মোবাইল রিচার্জ ও কোর্ট ফি জমা দেওয়ারও সুযোগ পাবেন।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম
পড়াশোনা আনন্দময় করতে পাঠ্যবই আকর্ষণীয় আর পাঠদান পদ্ধতি যুগোপযোগী করা দরকার। তাই যশোর জিলা স্কুল, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও যশোর কালেক্টরেট স্কুলে 'পাইলট প্রকল্প' হিসেবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক শায়লা নার্গিস শাওন। তিনি মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি দেখাচ্ছেন। দেখাচ্ছেন কিডনি দেখতে কেমন, কিডনি কোথায় থাকে। শায়লা নার্গিস বলেন, 'এ ব্যবস্থা চালু করায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় বেশি মনোযোগী হচ্ছে। তারা ছবি দেখে আনন্দের সঙ্গে একটি বিষয় সম্পর্কে জানছে। তারা ফলও ভালো করছে।' তবে এই শ্রেণীর ছাত্রী ঐশী জানায়, 'মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতিতে ক্লাস নেওয়ার জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু সব সময় বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে আমাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।' এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা বলেন, 'মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের জন্য অত্যাধুনিক রুমের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের রুমগুলো মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের উপযোগী নয়। এ ছাড়া বিষয়টি ব্যয়বহুল। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ব্যবস্থা চালু করা হলে শিক্ষার মান বাড়বে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।'
ইউসিসের মাধ্যমে পর্চা
জেলা ই-সেবাকেন্দ্রের পাশাপাশি ইউনিয়ন ই-সেবাকেন্দ্র থেকেও অনলাইনে আবেদন করে পর্চা পাওয়া যাচ্ছে। এতে সময়, অর্থ, শ্রম ও ভোগান্তি অনেক কমেছে। জেলা ই-সেবাকেন্দ্রে কথা হয় অভয়নগর উপজেলার সুখপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ শাহিদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমি পর্চা নেওয়ার জন্য এসেছি। আবেদন করেছি। আমাকে একটি ছোট কাগজ দেওয়া হয়েছে। তিন দিন পর আসতে বলা হয়েছে।' তিনি আরো বলেন, 'আগে মুহুরির মাধ্যমে তিন-চার শ টাকা দিয়ে পর্চা তুলেছি। এখন পর্চা তুলতে কোনো খরচ নেই।' জেলা ই-সেবাকেন্দ্রের কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, 'এই কেন্দ্রে আমরা পাঁচজন কাজ করছি। প্রতিদিন সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় শ আবেদনপত্র জমা পড়ছে। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জানাতে সময় বেশি লাগে না এখন।' এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'যশোর জেলায় প্রথম ই-সেবাকেন্দ্র চালু হয় ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত পর্চার জন্য আমাদের কাছে ৮৯ হাজার আবেদন পড়েছে। এর মধ্যে ৮২ হাজার পর্চা দেওয়া হয়েছে। আগে পর্চা দিতে ১৫-২০ দিন সময় লাগত। এখন তিন দিনে দেওয়া হচ্ছে।'
অনলাইন কোর্ট ফি
ই-সেবার বড় বাধা কোর্ট ফি। ইউনিয়ন ই-সেবাকেন্দ্র আবেদনপত্র গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু কোর্ট ফি নিতে পারে না। এ সমস্যার সমাধানে যশোরে প্রথম চালু করা হয়েছে 'অনলাইন কোর্ট ফি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম'। এর মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিয়ন ই-সেবাকেন্দ্র প্রিপেইড অ্যাকাউন্ট খুলবে। কেউ সেবার জন্য আবেদন করলে আইডি ব্যবহার করে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে কোর্ট ফি দিতে পারবেন। টাকা তার অ্যাকাউন্ট থেকে জেলা প্রশাসকের অ্যাকাউন্টে জমা হবে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব এটুআই প্রকল্পের পরিচালক নজরুল ইসলাম খান বলেন, 'কোর্ট ফির জন্য ই-সেবার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। কোর্ট ফি যাতে না লাগে সে জন্য আমরা আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। তবে যশোর জেলা প্রশাসন যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ইতিবাচক। আমরা দেশের অন্যান্য জেলার ই-সেবাকেন্দ্রে পর্যায়ক্রমে এ ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি।'
অনলাইনে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ
ইউনিয়ন ই-সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। জেলার আরবপুর ইউনিয়ন ই-সেবাকেন্দ্রে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের সময় কথা হয় বড় ভেকুটিয়া গ্রামের গ্রাহক আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আগে যশোর শহরের কারবালা এলাকায় গিয়ে সোনালী ব্যাংকে বিদ্যুৎ বিল জমা দিয়েছি। এতে সময় নষ্ট হয়েছে। লাইনে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ বিল জমা দিতে দিন পার হয়ে গেছে। এখন ইউনিয়ন ই-সেবাকেন্দ্রে এসে দুই মিনিটে বিদ্যুৎ বিল জমা দিতে পারছি।' এ ব্যাপারে এই কেন্দ্রের উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান বলেন, 'আমাদের কেন্দ্রে এখন প্রতিদিন ৬০-৭০টি বিদ্যুৎ বিল জমা পড়ছে। আমরা অনলাইনে পোস্টিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিল জমা নিচ্ছি। এ জন্য গ্রাহক আমাদের পাঁচ টাকা কমিশন দিচ্ছে। তাতে আমরাও লাভবান হচ্ছি।'
অনলাইন মোবাইল রিচার্জ
যশোরের জেলা প্রশাসন দেশের সব মোবাইল ফোন কম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে অনলাইন মোবাইল রিচার্জের ব্যবস্থা করেছে। এ জন্য কম্পিউটারে ইন্টারনেট সংযোগ থাকতে হবে। রিচার্জ করতে সময় লাগবে মাত্র ২৬ সেকেন্ড। ইউনিয়ন ই-সেবাকেন্দ্রের উদ্যোক্তারা নাগরিকদের মোবাইল রিচার্জের সেবা প্রদানের পাশাপাশি নিজেরাও কমিশন হিসেবে অর্থ আয় করতে পারবে।
এসএমএস সেবা
মোবাইল পরিষেবা টেলিটকের সঙ্গে চুক্তি করে জেলা প্রশাসন এসএমএস সেবা চালু করেছে। এখন জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভার জন্য আর লিখিত নোটিশ দেওয়া হয় না। এসএমএসের মাধ্যমে বার্তা পেঁৗছে দেওয়া হয়। এতে যেমন খরচ কমেছে, তেমনি উপস্থিতিও নিশ্চিত হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম বলেন, 'এসএমএস ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে প্রতি মাসে পাঁচ রিম কাগজ এবং তিন-চারজন কর্মচারীর ৫০-৬০ কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হচ্ছে। অনেক টাকাও বেঁচে যাচ্ছে।'
সভার কার্যপত্র
জেলা প্রশাসন এখন আর কোনো সভার সিদ্ধান্ত কাগজে লিখছে না। সভার কার্যপত্র জেলার তথ্য বাতায়নে প্রকাশ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবাই এখান থেকে সভার সিদ্ধান্ত জেনে নিচ্ছেন।
অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট
জেলা প্রশাসকের সাক্ষাৎ পেতে অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট চালু করা হয়েছে। এখন নাগরিকরা বাড়িতে বসেই জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে পারেন। আবেদন পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক তাঁর কর্মসূচি দেখে সাক্ষাতের সময় ও তারিখ এসএমএস অথবা ই-মেইল করে সাক্ষাৎ প্রার্থীকে জানিয়ে দেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, 'গত ছয় মাসে ৪৫০ জন অনলাইনে আবেদন করে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন।' ঢাকায় বসবাসরত ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান বলেন, 'আমার একটি বন্দুকের লাইসেন্স রয়েছে। আমি অনলাইনে আবেদন করে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে লাইসেন্স নবায়নের কাজ শেষ হয়।'
এসব ছাড়াও আউটসোর্সিং ফোরাম, ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম, অনলাইনে নতুন পাসপোর্ট তৈরির ফরম পূরণসহ তথ্যপ্রযুক্তির আরো অনেক সেবাই এখন যশোর জেলার অধিবাসীরা পাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি সচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, 'ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ আমরা যশোর থেকে শুরু করেছি। ভবিষ্যতে সরকারের সব অফিসে ই-সেবা কার্যক্রম শুরু হবে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা এ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'
প্রতিবেদকঃ ফকরে আলম
তথ্য সম্পাদনাঃ মোঃ হারুন -অর-রশিদ