
Home ধর্ম-সাধক / Religion-saint > হযরত বরখান গাজী (রঃ) / Hazrat Barkhan Gazi (R.)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 86766 বার পড়া হয়েছে
হযরত বরখান গাজী (রঃ) / Hazrat Barkhan Gazi (R.)
হযরত বরখান গাজী (রঃ)
Hazrat Barkhan Gazi (R.)
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের আগে যশোর ভূখন্ডে ইসলাম প্রচারের কোন ইতিহাস আমাদের জানা নেই। তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে হযরত বরখান গাজী এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। পুঁথি ও কাব্য কাহিনীর মাধ্যমে এ অঞ্চলে তাঁর ইসলাম প্রচার সম্পর্কে জানা যায়। তিনি উপমহাদেশের মানুষের কাছে শুধু গাজী নামেই পরিচিত ছিলেন।
মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয়ের অগেই ২৫টি ইসলাম প্রচারক দল বাংলাদেশে আসে বলে জানা যায়। পরে আরো কিছু দল বাংলাদেশে আসে যারা রাজনৈতিক গাজী নামে পরিচিত। এই দলের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হচ্ছেন- জায়েদ গাজী, হুসায়নী গাজী, মওদুদ গাজী, মুমীন গাজী, মুবাশ্বর গাজী, আমজাদ গাজী, সাবের গাজী, আব্দুল্লাহ গাজী প্রমুখ। এদের অধিকাংশ আরব দেশ থেকে এসেছিলেন। যশোরের শ্রীপুরে চারজন গাজীর পরিচয় পাওয়া যায়। গাজীদের ভিতর গাজী-কালু-চম্পাবতীর নামের সাথে জড়িত গাজী সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। পুঁথিতে তাঁর নাম বরখান গাজী বলা হয়েছে-
পোড়ারাজা গয়েশদি; তার বেটা সমসদি
পুত্র তার সাই সেকান্দার
তার বেটা বরখান গাজী; খোদাবন্দ মুকুলের কাজী
কলি যুগে তার অবসর
বাদশাহ ছিড়িল বঙ্গে; কেবল ভাই কালুর সঙ্গে
নিজ নামে হইল ফকির।
ষোল শতকের কবি শেখ ফয়জুল্লাহর সত্যপীর কাব্যের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, বরখান গাজী, ইসমাইল গাজী, সুফী খান ও জাফর খান গাজীর সমসাময়িক, ঐতিহাসিক ও প্রভাবশালী একজন স্বতন্ত্র পীর ছিলেন। সত্যপীর কাব্যের ভাষায়-
আম্বিয়ার হাসিল বন্দো পালান দুইজনে
এসমাইল গাজী বন্দো গড় মান্দারনে।
বন্দিব জেন্দাপীর কামা এর কুপি
বড়খান মুরিদ মিঞা করিল আপনি।
পাঁড়ুয়ার সাফিখাঁয়ে করি নিবেদন
অবশেষে বন্দিব সত্যপীরের চরণ।
পুঁথির মাধ্যমে জানা যায় বৈরাট নগরের বাদশাহ সেকান্দারের পুত্র হযরত বরখান গাজী (রঃ) ছিলেন। বৈরাট নগর স্থানটি কোথায় তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। বারোবাজারের নিকটবর্তী গ্রাম বেলাটের বাসিন্দাদের দাবী ‘বৈরাট নগর’ এর বিকৃত নাম বেলাট। কিন্তু সিলেটে বিরাট নগর নামে পাশাপাশি দুটো গ্রাম আছে। পুঁথির বিবরনে আরো জানা যায় যে, সমুদ্র পার হয়ে স্থলপথে কিছুদুর গিয়ে পুনরায় সমুদ্র উত্তীর্ন হন। এ তথ্য কেবল সিলেটের বেলায়ই ঘটে। সিলেট হাওরের দেশ। হাওর শব্দটি সাগর বা সায়র থেকে উদ্ভুদ্ধ। তাই আমরা বলতে চাই গাজীর পিতা শাহ সেকান্দারের রাজ্যের রাজধানী ছিল সিলেটের বিরাট নগরে।
বিরাট নগরের শাহ সেকান্দার ছিলেন গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের ভাগ্নে। সিলেটের এক শিলালিপীর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, শায়খুল মাশায়েখ মাখদুম শায়খ জালাল মুজাররাদ ইবনে মুহাম্মদের অনুকম্পায় শ্রীহট্ট শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ইসলামের প্রথম বিজয় সম্পন্ন হয় সেকান্দার খান গাজীর হাতে এবং সুলতান ফিরোজশাহ দেহলবীর শাসনামলে ৭০৩ হিজরী সনে (১৩০৩ খৃষ্টাব্দে)।
পূর্বে সিলেট রাজা গৌর গোবিন্দ শাসন করত। তাঁর রাজত্বকালে শায়খ বোরহান উদ্দীনের নামে এক মুসলমানের পুত্র সন্তান জন্ম উপলক্ষে গরু কোরবানি করলে রাজা গৌর গোবিন্দ গোহত্যার শাস্তি স্বরূপ তার দক্ষিণ হস্ত ছেদন করে এবং নবজাত শিশুটিকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। রাজার আদেশ কার্যকারি হয়। গৌর গোবিন্দের অকথ্য অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে শাস্তিপ্রাপ্ত মজলুম বুরহান উদ্দীন গৌড়ের সুলতান ফিরোজ শাহের নিকট প্রতিকার প্রার্থনা করলে সুলতান গৌর গোবিন্দকে শাস্তি দানের জন্য সেকান্দার গাজীকে এক বাহিনীসহ প্রেরণ করেন। যুদ্ধে গাজী পর পর দুবার পরাজিত হন। পরাজয়ের কথা শুনে সুলতান সাতগাও এর শাসনকর্তা নাসিরউদ্দীনকে সিলেটে প্রেরণ করেন। ইসলাম প্রচারক শাহ জালাল ও ৩৬০ জন সঙ্গীসহ তাদের সাথে যোগ দেন। যুদ্ধে গৌর গোবিন্দ পরাজিত হয়ে আসামের পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করেন। রাজ্য অধিকারের পর সিলেটের শাসনকার্যের ভার অর্পিত হয় সেকান্দার গাজীর উপর। এই গাজীরই পুত্র ছিলেন ব্রাহ্মণ নগর বিজয়ী বড় খাঁ গাজী। মুকুট রায় এই আমলের স্বাধীন হিন্দু নৃপতি ছিলেন।
জানা যায় শিশুকালেই গাজী এক মুর্শিদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ফলে দুনিয়ার লোভ লালসা তাঁর তিরোহিত হয়। শাহ সেকান্দারের ইচ্ছা ছিল তিনি নিজ পুত্র গাজীকে রাজ সিংহাসনে বসাবেন। কিন্তু গাজী রাজ সিংহাসন রেখে ফকিরী হালাতে জীবন কাটানো পছন্দ করলেন। শাহ সেকান্দার পুত্রকে দিয়ে তাঁর ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করলেন কিন্তু সব চেষ্টা ব্যার্থ হল। গাজী একদিন ভাই কালুকে নিয়ে রাজপুরী থেকে চলে গেলেন।
গাজী সুন্দরবনে সাত বছর মত অবস্থান করেন বলে জানা যায়। তিনি বিভিন্নভাবে সুন্দরবনে উপস্থিত হয়েছিলেন। এখানে তিনি কঠোর সাধনা করতেন। জানা যায় বনের বাঘ তাঁকে সম্মান করত, আদেশ নিষেধ মেনে বলত। পুঁথির ভাষায়-
ভ্রমিয়া অনেক দেশ
বাংলাতে অবশেষ
বসিলেন সুন্দরবনেতে
সেইখানে চিল্লা নিল
বনে যত বাঘ ছিল
শিষ্য হইল কাছেতে গাজীর।
ছিল হেন কেরামতে
চরাচরে বাঘ গত
সবে তারে মানিল যে পীর।
প্রায় সাত বছর সুন্দরবনে থাকার পর অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বারোবাজরে এসে উপস্থিত হন। বারোবাজারের ছাপাইনগরের রাজা শ্রীরামের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজা পরাজিত ও নিহত হন। রাজার পরাজয় ও মৃত্যুর পর তার শিশুপুত্র অজিত নারায়ণ জনৈকা দাসীর সহায়তায় রক্ষা পান এবং তাঁর পুত্র কমল নারায়ণ রায় বোধখানায় এসে বসতি স্থাপন করেন। এদের উপাধি ছিল রাজা। এখানকার বিখ্যাত চৌধুরী বংশের তিনি আদি পুরুষ ছিলেন। বাংলার বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এই বংশের সন্তান ছিলেন।
যাই হোক যুদ্ধের পর বারোবাজার এলাকার বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি বারোবাজারে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখান থেকেই দক্ষিণ বাংলায় ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়েছিল।
বারোবাজারে অবস্থান করার বেশ কিছুকাল পরে কালুর কথামত গাজী অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। চলতে চলতে একদিন ঘন বনে এক কাঠুরিয়ার সাথে পরিচয় হল। কাঠুরিয়ার সুন্দর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গাজী কালু সেখান আস্তানা গাড়েন। আস্তানাকে কেন্দ্র করে যে জনবসতি গড়ে ওঠে পরবর্তীতে তাঁর নাম সোনারপুর হয়। সেখানে কিছুদিন অবস্থানের পর অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। চলতি পথে একটি নদীর তীরে অবস্থিত কান্তাপুর গ্রামে উপস্থিত হন। নদীর ওপারে হিল ব্রাহ্মণ নগর। ব্রাহ্মণ নগরের রাজা ছিল মুকুট রায়। রাজা মুকুট রায়ের রাজ্য উত্তরে মহেশপুর হতে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি অত্যন্ত প্রতাপশালী ও মুসলমান বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম লীলাবতী। তাঁর সাত পুত্র ও এক কন্যা সন্তান ছিল। অতিশয় মুসলমান বিদ্বেষী হওয়ায় গাজীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং পরাজিত হয়ে আত্নহত্যা করেন। যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার নিকটবর্তী লাউজানি গ্রামের নাম এক সময় ব্রাহ্মণ নগর ছিল। মুকুট রায়ের রাজধানী আজ বিলুপ্ত। প্রাচীন পুঁথিতে সমৃদ্ধশালী মুকুট রায়ের রাজধানীর অত্যন্ত মনোরম পরিবেশের কথা বলা হয়েছে।
জানিবা তাহার নাম ব্রাহ্মণ নগর
চারিদিকে নদী তার দেখিতে সুন্দর।
সোনা দিয়া বান্ধিয়াছে ঘাট চারিখান
প্রতিঘাটে চারিশত সোনার নিশান।।
হেন পুরি নাহি ওগো ছিল রাবনের
মুকুট নামেতে রাজা সেইত দেশের।
পুঁথির মাধ্যমে জানা যায় ব্রাহ্মণ নগরের লোকজন সুখে শান্তিতে বসবাস করত এবং কোন দুঃখ তাদের স্পর্শ করতে পারত না।
নগর নিবাসী যত সব ধনবান
সে দেশে কাঙাল নাহি সকলে সমান।
সুবর্ণের কুম্ভ দিয়া আনে সব জল
বাটি ঘাটি থাল ঝারি সোনার সকল।।
একখানি ঘর নাহি সেই দেশে জুড়ি
দালান মন্দির মঠ সব বাড়ী বাড়ী।
পুঁথির মাধ্যমে জানা যায় খনিয়ান নগরে খুনিয়ার মাঠে মুকুট রাজার সাথে গাজীর যুদ্ধ হয়েছিল। কড়ির জাঙ্গালের বিস্তর প্রান্তর খুনিয়ার মাঠ নামে পরিচিত। গাজীর গান-
সাতশ গাড়ল লয়ে
দড়াটানা পার হয়ে
চললেন গাজী খনিয়া নগর
চল যাইরে।
বিভিন্ন সূত্র ধরে জানা যায় গাজী দীর্ঘদিন ব্রাহ্মণ নগরে অবস্থান করার পর আবার সুন্দরবনের দিকে রওনা হন। গাজীর সাথে চম্পা স্বামী স্ত্রী সাতক্ষীরার লাবসা গ্রামে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা দুজনাই ইসলাম প্রচারের কাজে ব্রত হন। চম্পার ধার্মিকজীবন মানুষকে মুগ্ধ করলে অঞ্চলের মানুষ তাকে ‘মা চম্পা’ বলে ডাকতে শুরু করে। চম্পা এখানেই ইন্তেকাল করেন। স্থানীয় জনগণ তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করেছিল কিন্তু কালের গর্ভে সেটা বিলীন হয়ে গেছে। চম্পার মৃত্যুর পর গাজী তাঁর পৈত্রিক নিবাস সিলেটে ফিরে যান। পুঁথির ভাষায়-
বিশগাও আছে সেই শ্রীহট্ট জেলায়
বাঘ লয়ে শাহা গাজী রহিল তথায়
কেহ কেহ বলে নাম গাজীপুর আর
হইয়াছে সেইখানে গাজীর আমার
সর্ব্বদা হাজী যায় সেইত মাযারে
হিন্দু মুসলমান যত মান্য সবে করে।
সিলেটে ফিরে যেয়ে ধর্মপ্রচার করতে থাকেন। তিনি হবিগঞ্জ মহকুমার বিশগাও গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। গাজীর নামানুসারে বিশগাওয়ের নাম গাজীপুর হয়েছিল। সেখানে তাঁর সমাধি বিদ্যমান। বিভিন্ন রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি ইসলামের প্রচারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাই গাজী, কালু ও চম্পাবতী তিনজনই ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্ব। তাঁরা তিনজনেই এদেশের মানুষের কাছে লৌকিক ব্যাক্তি হিসেবে বেঁচে আছে এবং থাকবেন। হযরত বরখান গাজী আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন প্রেরণার উৎস হয়ে তাঁর জীবন কর্মের মধ্য দিয়ে। তিনি অবিনশ্বর রূপে জগতের বুকে বেঁচে থাকবেন।
সম্পাদনা :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ আপডেট :
২০.০৫.১১