
Home ডিজিটাল যশোর (Digital Jessore) > যশোরে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র এবং তৃণমূল নারীর ক্ষমতায়ন
এই পৃষ্ঠাটি মোট 85339 বার পড়া হয়েছে
যশোরে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র এবং তৃণমূল নারীর ক্ষমতায়ন
"ওরি আমাইর কলের বাইকশো
বাশনা মাখা ভাদ্দুরে তাল
কি চমৎকার ডিজিটাল।”
যশোর জেলার প্রতিটি উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ অন্তর্ভুক্ত গ্রামে গ্রামে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় এই গীত বাজিয়ে ডিজিটাল সেবা গ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য জনগণের মাঝে প্রচারণা চালানো হয়েছিল। দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরের জেলা প্রশাসন অপরা অপর তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যম উদ্ভাবন করে এবং বাস্তবায়নের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এরই মধ্যে ১৩টি মাধ্যম সৃষ্টি করে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণের নানা ধরনের ৫৭প্রকার সেবা প্রদান করা হচ্ছে। জেলা ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র ছাড়াও উপজেলা ও ইউনিয়ন কেন্দ্রের মাধ্যমে একেবারে গ্রামপর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক সেবা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এ কারণেই ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে বিধবা ভাতা পেয়ে গ্রামের বয়োবৃদ্ধা সাবেদা খাতুন বেওয়ার মুখেও সেই আনন্দ গীত।
যশোর সদর উপজেলার অন্তর্গত গ্রাম পতেঙ্গালী। এই গ্রামের বৈশিষ্ট্য অদিগন্ত জুড়ে শুধু সবুজের সমারোহ। গ্রামের মানুষগুলোর মূল পেশা কৃষি। সব ধরনের ফসল এখানে উৎপন্ন হয়। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও মানুষগুলো মাটির সোঁদাল গন্ধ শুঁকে নিঃশ্বাস নিতে বেশি অভ্যন্ত। বর্তমানে জরিনা তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেই দিনকাল যাপন করছে। স্বামী ব্যবসার কাজে প্রায় সময় ঘরের বাইরে থাকেন। তাই সংসারে যাবতীয় কাজ তারই নিজ হাতে সম্পন্ন করতে হয়। আজও তাই প্রতিদিনকার মতো ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে, স্বামীকে ব্যবসার কাজে গঞ্জে যেতে দিয়ে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বেলা দ্বিপ্রহরের আগে হঠাৎ করে তার মনে আসে আজ বিদ্যুৎ বিল দেবার শেষ তারিখ। কাকে দিয়ে বিলটি পরিশোধ করতে স্থানীয় ব্যাংকে পাঠাবেন বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন। তখনই তার স্মরণ হলো। কালক্ষেপণ না করে জরিনা ছুটে যায় তার পাশের গ্রাম আবরপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে । মাত্র পাঁচ মিনিট সময়ে মধ্যে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে ঘরে ফিরে এসে আবারও রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ কিছুদিন আগেও উপজেলা সদরে গিয়ে ব্যাংকে দীর্ঘ লাইন দিয়ে বিদ্যুত বিল দিতে হতো। একবার তো সদরের ব্যাংকে বিদ্যুত বিল প্রদান করতে গিয়ে তার স্বামীর নতুন ক্রয় করা সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। তাছাড়া ১১০টাকার বিল দিতে গিয়ে ৪৫টাকা যাতায়াত ভাড়া ব্যয় হয়। কিন্তু এখন গ্রামের মানুষদের কাছে বিশেষ করে নারীদের কাছে কত সহজ হয়ে ওঠেছে সবকিছু এভাবে অভিমত ব্যক্ত করলেন জরিনা বেগম।
যশোর সদর উপজেলার ভেকুটিয়া গ্রামের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র শরিফ নেওয়াজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা প্রথম পর্বে ভর্তি জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাজশাহী গিয়ে বিপাকে পড়ে যায়। তার সমস্যার কারণ ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কমতি পড়ে যায়। উপায়ন্তর না পেয়ে সে বাড়িতে একমাত্র অভিভাবক মাকে জানান। শরিফ নেওয়াজের মা রেবেকা হোসেন সন্তানের এমন বিপদের কথা গ্রামের স্কুলের মাস্টার রফিক উদ্দিনের সাহায্য চাইলে রফিকউদ্দিন পাশের গ্রাম আরবপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে গিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বাড়তি টাকা পাঠিয়ে দিলে শরিফ নিশ্চিন্তে নির্ধারিত তারিখ ও সময়ের মধ্যে ভর্তি হতে সক্ষম হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি গ্রামে বসে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীদের বিভিন্ন স্থানে কর্মসংস্থান হচ্ছে। ৬০ কিলোমিটার দূরের স্থানীয় ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র থেকে ক্ষতিগ্রস্ত নারী জেলা প্রশাসকের কাছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আবেদন করতে পারছেন। সেবা কেন্দ্রের নারী উদ্যোক্তারা এখন প্রতিমাসে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করছেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রবাসে কর্মরত বাবা-ভাইদের সঙ্গে আপনজনরা সানন্দে কথা বলতে পারছে। আবার সেবা কেন্দ্রে এসে বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বখাটের সম্পর্র্কে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অবহিত করছেন। সরেজমিনে ঘুরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের এমন ইতিবাচক তথ্য পাওয়া যায়। প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে এভাবেই নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যশোর জেলায় প্রথম ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র চালু হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের অধীন যশোরের জেলা প্রশাসন ডিজিটাল সেবার বিষয়টি বাস্তবায়ন করেন। পরে জেলার ৫১টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়। এ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ৫১ জন পুরুষ ও ৫১জন নারী উদ্যোক্তা। গ্রামের দরিদ্র, শিক্ষিত নারী উদ্যোক্তারা এখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিমাসে ৩ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করছেন। আরবপুর সেবা কেন্দ্রের রাবেয়া খাতুন জানান, “আমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছি। বেকার কর্মহীন ছিলাম। এখন তথ্য কেন্দ্রে অন্যদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিমাসে উপার্জন করছি ১৫ হাজার টাকা। এখন সংসার সুখের হয়েছে। ”
যশোর জেলা তথ্য অফিসার শিবপ্রদ ম-ল বলেন, আবরপুর সেবা কেন্দ্রের পাশে মুক্তেশ্বরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ছাত্রীদের স্কুল পথে নিত্যদিন বখাটে যুবকরা ইভটিজিং করত। এমনই একদিন একদল বখাটে ছাত্রীদের স্কুল পথে ইভটিজিং করলে ছাত্রীরা সেই সময়ে সেবা কেন্দ্রে ছুটে গিয়ে অনলাইনে জেলা প্রশাসকের বরাবর এসএমএস বার্তা পাঠায়, জেলা প্রশাসক বার্তা পেয়ে তৎক্ষণাৎ পুলিশ প্রশাসনকে জানালে, পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বখাটেদের আইনের আশ্রয়ে নিয়ে আসে।
সাতক্ষীরা জেলার অষ্টাদশী তরুণী রেশমা ও চৌগাছার একই বয়সী তানিয়া যশোরের আহসানিয়া মিশন শেল্টার হোমে দিনযাপন করত। একটা সময় তারা কর্মের তাগিদ অনুভব করলে আরবপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে এসে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেয় ফলশ্রুতিতে আহসানিয়া মিশনেই উভয়ের কর্মসংস্থান হয়ে যায়। কেন্দ্রের উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান তুহিন এ প্রসঙ্গে বলেন, তথ্য ও সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে এ যাবত আমরা ২০০ নারীকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান করতে পেরেছি। তাদের মধ্যে থেকে প্রায় অধিকাংশেরই কর্মসংস্থান হয়েছে।
যশোর জেলা প্রশাসক বলেন, “তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে কেশবপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা থেকে আমার কছে আবেদন আসে সাতবাড়িয়া গ্রামের জনৈকা ফিরোজা খাতুনের তার স্বামীর সামান্য জমি তার স্বামীর ভাই বেদখল করেছে। আমি ব্যাপারটি প্রত্যক্ষভাবে নিরীক্ষণ করার জন্য সেই সময়ে নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ প্রদান করি। নির্দেশ অনুযায়ী ফিরোজা খাতুন তার জমি দখল ফিরে পায়। তিনি আরও বলেন, নিরুপায়, সাহায্যহীন, অভিভাবহীন এমন অনেক নারী এখন অনলাইনে সুবিচার চেয়ে আবেদন করলে সেসব আবেদন মুহূর্তের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করছি।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণের কাছে স্বল্প সময়ে কম খরচে দ্রুত তথ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার এবং অন-লাইন সুবিধা প্রদান করে সারা দুনিয়ার যথেচ্ছ জ্ঞান ভাণ্ডারের সঙ্গে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের সংযোগ ঘটানোই “ডিজিটাল বাংলাদেশ। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষগুলোকে জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সংম্পৃক্ত করা অভিপ্রায়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অনস্বীকার্য। আর এই শুভ-ইচ্ছায় দেশের ৪৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদে ‘ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র’ (ইউআইএসসি) সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করে ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে তথ্য সেবা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে ইউআইএসসির গ্রহণযোগ্যতা ও এর কার্যকারিতার কথা ভেবে সরকার জনগণ ও উদ্যোক্তার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ইউআইএসসির ‘সরকার- উদ্যোক্তা-জনগণ’ প্রক্রিয়া অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়ের দু’জন নব তরুণ উদ্যোক্তা কমপক্ষে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও কম্পিউটার তার কার্য সম্পর্কে ধারণা সম্পর্কিত নারী ও পুরুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচন করা হয়। উদ্যোক্তা নির্বাচন করে থাকেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তায়। সকল ইউআইএসসির বাস্তবায়নের ফলে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে ৯ হাজারের বেশি মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে আশার কথা এই বিশাল জনশক্তির অর্ধেকই নারী।
বাশনা মাখা ভাদ্দুরে তাল
কি চমৎকার ডিজিটাল।”
যশোর জেলার প্রতিটি উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ অন্তর্ভুক্ত গ্রামে গ্রামে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় এই গীত বাজিয়ে ডিজিটাল সেবা গ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য জনগণের মাঝে প্রচারণা চালানো হয়েছিল। দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরের জেলা প্রশাসন অপরা অপর তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যম উদ্ভাবন করে এবং বাস্তবায়নের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এরই মধ্যে ১৩টি মাধ্যম সৃষ্টি করে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণের নানা ধরনের ৫৭প্রকার সেবা প্রদান করা হচ্ছে। জেলা ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র ছাড়াও উপজেলা ও ইউনিয়ন কেন্দ্রের মাধ্যমে একেবারে গ্রামপর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক সেবা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এ কারণেই ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে বিধবা ভাতা পেয়ে গ্রামের বয়োবৃদ্ধা সাবেদা খাতুন বেওয়ার মুখেও সেই আনন্দ গীত।
যশোর সদর উপজেলার অন্তর্গত গ্রাম পতেঙ্গালী। এই গ্রামের বৈশিষ্ট্য অদিগন্ত জুড়ে শুধু সবুজের সমারোহ। গ্রামের মানুষগুলোর মূল পেশা কৃষি। সব ধরনের ফসল এখানে উৎপন্ন হয়। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও মানুষগুলো মাটির সোঁদাল গন্ধ শুঁকে নিঃশ্বাস নিতে বেশি অভ্যন্ত। বর্তমানে জরিনা তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেই দিনকাল যাপন করছে। স্বামী ব্যবসার কাজে প্রায় সময় ঘরের বাইরে থাকেন। তাই সংসারে যাবতীয় কাজ তারই নিজ হাতে সম্পন্ন করতে হয়। আজও তাই প্রতিদিনকার মতো ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে, স্বামীকে ব্যবসার কাজে গঞ্জে যেতে দিয়ে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বেলা দ্বিপ্রহরের আগে হঠাৎ করে তার মনে আসে আজ বিদ্যুৎ বিল দেবার শেষ তারিখ। কাকে দিয়ে বিলটি পরিশোধ করতে স্থানীয় ব্যাংকে পাঠাবেন বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন। তখনই তার স্মরণ হলো। কালক্ষেপণ না করে জরিনা ছুটে যায় তার পাশের গ্রাম আবরপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে । মাত্র পাঁচ মিনিট সময়ে মধ্যে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে ঘরে ফিরে এসে আবারও রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ কিছুদিন আগেও উপজেলা সদরে গিয়ে ব্যাংকে দীর্ঘ লাইন দিয়ে বিদ্যুত বিল দিতে হতো। একবার তো সদরের ব্যাংকে বিদ্যুত বিল প্রদান করতে গিয়ে তার স্বামীর নতুন ক্রয় করা সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। তাছাড়া ১১০টাকার বিল দিতে গিয়ে ৪৫টাকা যাতায়াত ভাড়া ব্যয় হয়। কিন্তু এখন গ্রামের মানুষদের কাছে বিশেষ করে নারীদের কাছে কত সহজ হয়ে ওঠেছে সবকিছু এভাবে অভিমত ব্যক্ত করলেন জরিনা বেগম।
যশোর সদর উপজেলার ভেকুটিয়া গ্রামের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র শরিফ নেওয়াজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা প্রথম পর্বে ভর্তি জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাজশাহী গিয়ে বিপাকে পড়ে যায়। তার সমস্যার কারণ ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কমতি পড়ে যায়। উপায়ন্তর না পেয়ে সে বাড়িতে একমাত্র অভিভাবক মাকে জানান। শরিফ নেওয়াজের মা রেবেকা হোসেন সন্তানের এমন বিপদের কথা গ্রামের স্কুলের মাস্টার রফিক উদ্দিনের সাহায্য চাইলে রফিকউদ্দিন পাশের গ্রাম আরবপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে গিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বাড়তি টাকা পাঠিয়ে দিলে শরিফ নিশ্চিন্তে নির্ধারিত তারিখ ও সময়ের মধ্যে ভর্তি হতে সক্ষম হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি গ্রামে বসে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীদের বিভিন্ন স্থানে কর্মসংস্থান হচ্ছে। ৬০ কিলোমিটার দূরের স্থানীয় ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র থেকে ক্ষতিগ্রস্ত নারী জেলা প্রশাসকের কাছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আবেদন করতে পারছেন। সেবা কেন্দ্রের নারী উদ্যোক্তারা এখন প্রতিমাসে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করছেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রবাসে কর্মরত বাবা-ভাইদের সঙ্গে আপনজনরা সানন্দে কথা বলতে পারছে। আবার সেবা কেন্দ্রে এসে বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বখাটের সম্পর্র্কে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অবহিত করছেন। সরেজমিনে ঘুরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের এমন ইতিবাচক তথ্য পাওয়া যায়। প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে এভাবেই নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যশোর জেলায় প্রথম ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র চালু হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের অধীন যশোরের জেলা প্রশাসন ডিজিটাল সেবার বিষয়টি বাস্তবায়ন করেন। পরে জেলার ৫১টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়। এ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ৫১ জন পুরুষ ও ৫১জন নারী উদ্যোক্তা। গ্রামের দরিদ্র, শিক্ষিত নারী উদ্যোক্তারা এখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিমাসে ৩ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করছেন। আরবপুর সেবা কেন্দ্রের রাবেয়া খাতুন জানান, “আমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছি। বেকার কর্মহীন ছিলাম। এখন তথ্য কেন্দ্রে অন্যদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিমাসে উপার্জন করছি ১৫ হাজার টাকা। এখন সংসার সুখের হয়েছে। ”
যশোর জেলা তথ্য অফিসার শিবপ্রদ ম-ল বলেন, আবরপুর সেবা কেন্দ্রের পাশে মুক্তেশ্বরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ছাত্রীদের স্কুল পথে নিত্যদিন বখাটে যুবকরা ইভটিজিং করত। এমনই একদিন একদল বখাটে ছাত্রীদের স্কুল পথে ইভটিজিং করলে ছাত্রীরা সেই সময়ে সেবা কেন্দ্রে ছুটে গিয়ে অনলাইনে জেলা প্রশাসকের বরাবর এসএমএস বার্তা পাঠায়, জেলা প্রশাসক বার্তা পেয়ে তৎক্ষণাৎ পুলিশ প্রশাসনকে জানালে, পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বখাটেদের আইনের আশ্রয়ে নিয়ে আসে।
সাতক্ষীরা জেলার অষ্টাদশী তরুণী রেশমা ও চৌগাছার একই বয়সী তানিয়া যশোরের আহসানিয়া মিশন শেল্টার হোমে দিনযাপন করত। একটা সময় তারা কর্মের তাগিদ অনুভব করলে আরবপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে এসে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেয় ফলশ্রুতিতে আহসানিয়া মিশনেই উভয়ের কর্মসংস্থান হয়ে যায়। কেন্দ্রের উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান তুহিন এ প্রসঙ্গে বলেন, তথ্য ও সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে এ যাবত আমরা ২০০ নারীকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান করতে পেরেছি। তাদের মধ্যে থেকে প্রায় অধিকাংশেরই কর্মসংস্থান হয়েছে।
যশোর জেলা প্রশাসক বলেন, “তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে কেশবপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা থেকে আমার কছে আবেদন আসে সাতবাড়িয়া গ্রামের জনৈকা ফিরোজা খাতুনের তার স্বামীর সামান্য জমি তার স্বামীর ভাই বেদখল করেছে। আমি ব্যাপারটি প্রত্যক্ষভাবে নিরীক্ষণ করার জন্য সেই সময়ে নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ প্রদান করি। নির্দেশ অনুযায়ী ফিরোজা খাতুন তার জমি দখল ফিরে পায়। তিনি আরও বলেন, নিরুপায়, সাহায্যহীন, অভিভাবহীন এমন অনেক নারী এখন অনলাইনে সুবিচার চেয়ে আবেদন করলে সেসব আবেদন মুহূর্তের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করছি।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণের কাছে স্বল্প সময়ে কম খরচে দ্রুত তথ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার এবং অন-লাইন সুবিধা প্রদান করে সারা দুনিয়ার যথেচ্ছ জ্ঞান ভাণ্ডারের সঙ্গে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের সংযোগ ঘটানোই “ডিজিটাল বাংলাদেশ। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষগুলোকে জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সংম্পৃক্ত করা অভিপ্রায়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অনস্বীকার্য। আর এই শুভ-ইচ্ছায় দেশের ৪৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদে ‘ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র’ (ইউআইএসসি) সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করে ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে তথ্য সেবা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে ইউআইএসসির গ্রহণযোগ্যতা ও এর কার্যকারিতার কথা ভেবে সরকার জনগণ ও উদ্যোক্তার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ইউআইএসসির ‘সরকার- উদ্যোক্তা-জনগণ’ প্রক্রিয়া অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়ের দু’জন নব তরুণ উদ্যোক্তা কমপক্ষে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও কম্পিউটার তার কার্য সম্পর্কে ধারণা সম্পর্কিত নারী ও পুরুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচন করা হয়। উদ্যোক্তা নির্বাচন করে থাকেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তায়। সকল ইউআইএসসির বাস্তবায়নের ফলে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে ৯ হাজারের বেশি মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে আশার কথা এই বিশাল জনশক্তির অর্ধেকই নারী।