
Home সাহিত্যিক / Litterateur > মহাকবি যাযাবর ওসমান / Zazabar Osman (1940)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 87169 বার পড়া হয়েছে
মহাকবি যাযাবর ওসমান / Zazabar Osman (1940)
যাযাবর ওসমান মহাকবি এবং কবি হিসেবে দেশে- বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৬। এর মধ্যে ১৩টি কাব্য গ্রন্থ। ৬টি ইংরেজি ভাষায়, ৭টি বাংলা ভাষায়। ইংরেজি ভাষায় একটি উপন্যাস রচনা করেছেন। তার অনুবাদ গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি লিখেছেন প্রবন্ধ, ছড়া ও সঙ্গীত।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলার অন্তর্গত সাপখোলা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত সিকদার পরিবারে যাযাবর ওসমানের জন্ম। পিতার নাম মৌলভি আব্দুল গনি সিকদার এবং মাতার নাম মোসাম্মৎ মাজেদা খাতুন। কবি শৈশবে তার মাতাকে হারান। যাযাবর ওসমানের পরিবার প্রদত্ত নাম মোঃ ওসমান আলী সিকদার।
যাযাবর ওসমানের আদিপুরুষ আরবদ্দীন শাহ ভাগ্যের অন্বেষণে নওয়াব আলীবর্দী খাঁর রাজত্বকালে (১৭৪০-১৭৫৬) সুবে বাংলায় আগমন করেন ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে। আরবদ্দীন শাহ ছিলেন আরবি ও ফার্সি ভাষায় সুপন্ডিত। নওয়াব আলীবর্দী খাঁর অনুগ্রহে তিনি যশোরের এক পরগনার সিকদার নিযুক্ত হন। তিনি নড়াইলে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। নওয়াব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের (১৭৫৭ খ্রি.) পর আরবদ্দীন সিকদার ইংরেজদের কর্তৃক ধৃত ও নিহত হন। তার শিশু পুত্র বানু সিকদার মায়ের সাথে পালিয়ে মাগুরায় পাল্লা গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহন করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীতে বানু ইংরেজদের রোষানলে পড়েন এবং তাদের কর্তৃক ধৃত হন এবং চিরদিনের মত নিখোঁজ হন। বানু সিকদারের তিন শিশুপুত্র বয়োঃপ্রাপ্ত হয়ে পিতা ও পিতামহের হত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ দুই গোরা সিপাহীকে হত্যা করে ঝিনাইদহের শৈলকূপা থানার সাপখোলা গ্রামে পালিয়ে যান। বানু সিকদারের জ্যৈষ্ঠ পুত্র ওয়ালী মোহাম্মদ সিকদার ছিলেন আরবি ও ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত ও কামেল পীর। ওয়ালী মোহাম্মদ সিকদার যাযাবর ওসমানের পঞ্চম উর্দ্ধতন পুরুষ।
গৃহশিক্ষক মাওলানা ইবরাহীম বিশ্বাসের কাছে যাযাবর ওসমানের বিদ্যাশিক্ষার হাতেখড়ি। অতঃপর তিনি শেখরা ইউপি স্কুল, ফলিয়া এম ই স্কুল, ঝিনাইদহ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বুনাগাতী আমজাদ আলী হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাগুরা শহীদ সোহরাওয়ারর্দী কলেজ থেকে কৃতিত্বের সহিত আইএ পাস করেন। যাযাবর ওসমান ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে দৌলতপুর বিএল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এবং ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে যাযাবর ওসমান মাগুরা জেলার শ্রীরামপুর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাওয়ালপিন্ডির চাকলালা কেন্দ্রীয় সরকারি বালক-বালিকা বিদ্যালয়ে সিনিয়র ইংলিশ টিচার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৭-৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েটের ইকোনমিক এ্যাফেয়ার্স বিভাগে সহকারী এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে অতিরিক্ত সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগে তিনি ২৪ বছর চাকরি করেন এবং সহকারী কমিশনার হিসেবে অবসর গ্রহন করেন।
যাযাবর ওসমান বাল্যকাল থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন। তার প্রথম কবিতা মোনাজাত ৮ম শ্রেণিতে পাঠ্যাবস্থায় রচিত হয় এবং অসংখ্য মানুষের প্রশংসা লাভ করেন। নজরুল ইসলামের ভাবধারায় তিনি কবিতা লিখতে থাকেন ।
৬০ দশকে কবি হিসেবে যাযাবর ওসমানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম যাযাবর ওসমানের একটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় । গ্রন্থটির নাম Nawab Abdul Latif, the Pioneer of Muslim Modernism in Bengal. ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে যযাবর ওসমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ To Colonel Muammer- E1 Gaddafi প্রকাশিত হয়। ৭৬ পৃষ্ঠার এ কাব্যগ্রন্থে মহাকাব্যিক সুর সুস্পষ্ট ।এটাকে একটা ক্ষুদ্র মহাকাব্য বলে অভিহিত করা যায় এ গ্রন্থের জন্য ১৯৭৭ ও ৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কবি লিবিয়া সরকার কর্তৃক দু’বার আমন্ত্রিত হন ।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার Two Great Personalities শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় কবির A Prologue to OIC শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ । এই গ্রন্থে তিনি মুসলিম জাতির ঐক্য সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও বিশ্বশান্তির কথা বলেছেন।
আশির দশকে বাংলা ভাষায় তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। যথা- সোনালী দিগন্তের প্রতীক্ষায় (১৯৮৫), যুদ্ধ নয় শান্তি (১৯৮৭), হাভাতের প্রার্থনা (১৯৮৮) এবং সংবর্তধ্বনি (১৯৯০)। এ কাব্যগুলি মানুষের মনে বিপুল সাড়া জাগায় । যাযাবর ওসমানের কবিতায় মাটি ও মানুষের কথা ফুটে উঠেছে। তাঁর কবিতা আধুনিকতায় সমৃদ্ধ হলেও দুর্বোধ্য ও জটিল নয়। সবদিক দিয়ে বিশুদ্ধ কবিতার তিনি জনক। সহজ সরল ভাষায় তিনি তাঁর মনের কথা প্রকাশ করেন ।
নব্বইয়ের দশকে যাযাবর ওসমানের ৪ টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এরমধ্য দুটো ইংরেজি ভাষায় এবং দুটো বাংলা ভাষায় । গ্রন্থগুলো হলোঃ The Wave of Democracy, Harbinger of Peace (1993), হাজার বছর পরে (১৯৯৬) এবং রাহুমুক্তি (২০০০)।
The Wave of Democracy গ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় কবি গণতন্ত্রের জয়গান গেয়েছেন। গণতন্ত্রের প্রমূর্ত ছবি এই গ্রন্থে মূর্ত হয়ে উঠেছে । গণতন্ত্রের এমন সুন্দরতম অভিব্যক্তি আর কোন বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের মাঝে প্রকাশ পায়নি । কবি যাযাবর ওসমান বিশ্বের মানব জাতিকে গণতন্ত্রের পতাকা তলে সমবেত হওয়ার জন্য উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। এই বইয়ে স্থান পাওয়া প্রতিটি কবিতা যেন একেক খণ্ড হিরক । বিশেষ করে Save Mankind প্রকৃত অর্থেই সর্বাধিক প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। শুধু The Wave of Democracy বইটি তাকে শত শত বছর বাঁচিয়ে রাখবে এই পৃথিবীতে । গণতন্ত্রের উপর লেখা বইখানি গণতন্ত্রের পথিকৃৎ হয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে ।
যাযাবর ওসমানের Harbinger of peace আন্তর্জাতিক মানের একটি কাব্যগ্রন্থ । এতে বিভিন্ন বিষয়ে ৫৯ টি কবিতা সংকলিত হয়েছে । এ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন অধ্যাপক কবির চৌধুরী । তিনি বলেন, Osman is a Serious Poet who has some definite things to say and who knows, by and large, to say them with both vigour and grace. The first poem after which the book is named is a fairly long one and has a whitmanesque flavour, its central theme is glorification of democracy and true democrats, but what gives the poem an added dimension is a certain metaphysical outlook of the poet.
এ গ্রন্থটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের নিকট পাঠানো হয়েছিল। বইটি পেয়ে তিনি যাযাবর ওসমানকে যে চিঠি লিখেন তা হলো -
Thank you for the kind words and your thoughtful gift. We appreciate you remembering us in this special way and very grateful for your support- Bill Clinton
যাযাবর ওসমানের কালজয়ী মহাকাব্য ‘রাহুমুক্তি’ মুক্তিযুদ্ধের পেক্ষাপটে রচিত । দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা দেশপ্রেমিক কোনো রাজনীতিককে নিয়ে বিশ্বের কোন দেশেই মহাকাব্য রচিত হয়নি । সব মহাকাব্যই রচিত হয়েছে পৌরাণিক, Biblical, কল্পনাপ্রসূত দূর অতীতের কোনো ঘটনা নিয়ে । এ দিক দিয়ে ‘রাহুমুক্তি’ ব্যতিক্রমধর্মী । মর্ত্যের মানুষের স্বাধিকার, অধিকার নিয়ে লেখা এ কাব্যটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার এক উৎকৃষ্ট দলিল ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর । এতে বিধৃত হয়েছে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কথা । এটা বাঙালি জাতিসত্ত্বার ইতিহাস । এই মহাকাব্যের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধুই বিশ্বের কোন মহাকাব্যের প্রথম মহানায়ক । এই গ্রন্থ সম্পর্কে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন- যে ক’টি উপাদান ও গুণাবলীর সমন্বয়ে মহাকাব্য সার্থকতা লাভ করে তাঁর প্রায় সব কটি উপাদান ‘রাহুমুক্তি’তে বিদ্যমান । রাহুমুক্তি বীররসে রচিত হলেও করুণ রসের সঞ্চার হয়েছে কিছু কিছু জায়গায় । বীররসে সিক্ত এই মহাকাব্যখানিতে রয়েছে প্রচুর নাটকীয়তা । রচনাশৈলী ভাষার লালিত্য, গাম্ভীর্য, ছন্দের কারুকার্য ও বর্ণনার সৌন্দর্যে রাহুমুক্তি এক আকর্ষণীয় সৃষ্টি । বিশ্বের অধিকাংশ মহাকবির মহাকাব্যে দেখা গেছে পুরাতন জিনিস নতুন পাত্রে ঢেলে নতুনত্ব দান করেছেন ।
পুরাতনকে নতুন পোশাকে আকর্ষণীয় ও মহিমাময় করে তোলার চেষ্টা করেছেন । যাযাবর এখানে নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমধর্মী , তাঁর লেখনীতে অবাস্তব এবং কল্পনাপ্রসূত কোন কাহিনী ঠাঁই পায়নি । তিনি রুঢ় বাস্তবতার নিরিখে রচনা করেছেন এক বিশাল কলেবরের কাহিনী কাব্য’।
বাংলা সাহিত্য মহাকাব্য কমই লেখা হয়েছে । মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং মহাকবি কায়কোবাদের তিনি সাক্ষাত উত্তরসূরি । তাঁকে মহাকবি বলে অভিহিত করা যেতে পারে । ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ To a Great Soul of Democracy প্রকাশিত হয় । এ গ্রন্থে বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত লোকদের নিষ্পেষণ ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা করে সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা এবং পৃথিবী থেকে দ্বন্দ্ব কলহ সংঘাত ও অহেতুক রক্তপাত বন্ধের জন্য কবি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। বরের পিসি কন্যার মাসি এ ধরনের ঘৃণ্য পলিসি পরিহার করার জন্য সানুনয় প্রার্থনা করেছেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট ওবামাকে আহবান জানিয়েছেন। যাযাবর ওসমান ‘ব্লাড স্পিকস’ নামে বিশাল কলেবরের একটি উপন্যাস লিখেছেন । প্রকাশকাল – ২০০৯ ।
উপন্যাসটি শুধু বাংলাদেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর নয়, এটা সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। কবি দীর্ঘকাল ধরে লিখে আসছেন । ৭৪ বছর উর্দ্ধে তাঁর বয়স । শীঘ্রই Democracy Wins নামে ৩৫০০০ (পয়ত্রিশ হাজার ) পংক্তির একটি বিশাল কলেবরের ইংরেজি মহাকাব্য প্রকাশিত হতে যাচ্ছে কলেবরের দিক থেকে এটা হবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাকাব্য ।
সাহিত্য ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন । এরমধ্যে মাইকেল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫), শেরে বাংলা স্বর্ণপদক (১৯৯১), স্বরবীথি থিয়েটার পুরস্কার (১৯৯২), পিসি সরকার পুরস্কার (১৯৯৩), চিত্রালী পাঠক-পাঠিকা সংসদ পুরস্কার (১৯৯৩), সাহিত্যিক আবিদ হোসেন পুরস্কার (২০১১), পূর্ণিমা বাসর সাহিত্য পুরস্কার ২০১৩ উল্লেখযোগ্য ।