
Home সাহিত্যিক / Litterateur > মাইকেল মধুসূদন দত্ত / Michael Madhusudan Dutt (1824-1873)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 102101 বার পড়া হয়েছে
মাইকেল মধুসূদন দত্ত / Michael Madhusudan Dutt (1824-1873)
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
Michael Madhusudan Dutt
Home District: Jessore, Keshabpur
Photo Gallery
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে; তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত্ত
দত্ত-কুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসুদন।
যশোরে সাগরদাঁড়ী কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমী, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।
পারিবারিক প


বঙ্গের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যশোর জেলার সাগরদাঁড়ী গ্রামে ১৮২৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী শনিবার জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতা সদর দেওয়ানী আদালতের একজন নামকরা আইন ব্যবসায়ী। মাতা জাহ্নবী দেবী ছিলেন তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত কাঠি পাড়ার জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা।
শিক্ষাজীবন:
শিশুকালে মধুসূদনের হাতে খড়ি হয়েছিল তাঁদের বাড়ীর চন্ডীমণ্ডপে। এরপর তিনি তাঁর গ্রামের নিকটবর্তী শেখপুরা গ্রামের এক মৌল

খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ ও মাদ্রাজ গমন:
খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করায় মাইকেল পিতার অর্থ সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে পারিবারিক স্নেহের নোঙ্গর ছিঁড়ে মাদ্রাজের পথে পাড়ি জমান। এখানে প্রথমে মাদ্রাজ ‘মেল অরফ্যান অ্যাসাইলাম’ বিদ্যালয়ে ইংরেজী শিক্ষকের চাকরি গ্রহণ করেন। পরে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। মাদ্রাজ প্রবাসকালে তাঁর সাহিত্য প্রতিভা উজ্জ্বীবিত হয়ে ওঠে। এই সময়ে তিনি লিখতেন ইংরাজী কাব্য "Captive Lady" ও "Visions of the past" এখানে তিনি কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ইংরাজী ভাষায় প্রথম নাটক "Riza" (Empress of India) এখান থেকেই প্রকাশিত হয়।

কর্মজীবন:
মাইকেল মাদ্রাজ থেকে কোলকাতায় ফিরে এসে কবি দেখলেন, তাঁর পিতা-মাতা ইতঃপূর্বেই ইহজগৎ ত্যাগ করেছেন এবং তাঁদের অনেক সম্পত্তি অন্যেরা দখল করে নিয়েছে। অগত্যা মধুকবি পুলিশ আদালতে সামান্য কেরানীর চাকরি গ্রহণ করেন।
মধুসূদনের দূর্দিনে একমাত্র সুহৃদ ছিলেন বিদ্যাসাগর। আপন অসচ্ছলতা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর বহু অর্থ ব্যয় করেন মধুসূদনের ব্যারিস্টারী পড়ার জন্যে। লন্ডনের ‘গ্রেজ ইন’ থেকে ব্যারিস্টারী পাস করে দেশে ফিরে ১৭-১১-১৮৬৬ তারিখে কলকাতা বারে যোগদান করেন এবং ৭-৫-১৮৬৭ তারিখে হাইকোর্ট বারে যোগদান করেন। পরে তাঁকে প্রিভিউ কাউন্সিলের ‘আপীল একজামিনার’ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
বিলেত গমন:
মহাকাব্যের স্রষ্টা মাইকেল মধুসূদন দত্ত সাহিত্যিক জীবনে স্বদেশে খ্যাতি ও যশ লাভ করেও পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। দুর্বার উচ্চকাঙ্খা ও অপরিতৃপ্ত বাসনা তাঁর শৈল্পিক স্বত্ত্বাকে স্বদেশের মাটি থেকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় দেশ দেশান্তরে। ১৮৬২ সালে জুন মাসের ৯ তারিখে ব্যারিস্টারী পড়ার মনোবাসনায় তিনি স্ত্রী, পুত্র কন্যা কোলকাতায় রেখে বিলাত যাত্রা করেন।

যে আর্থিক নিরাপত্তার আশ্বাসে তিনি বিলাত যাত্রা করেন, অচিরেই তা ভঙ্গ হলো। তাঁর ভূসম্পত্তির পত্তনীদার ও প্রতিভূরা তাঁকে বিলাতে ও তাঁর স্ত্রীকে কোলকাতায় টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে মে মাসের ২ তারিখে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে দুটি শিশু সন্তানসহ তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরীয়েটা কলকাতা ছেড়ে ইংল্যান্ডে স্বামীর নিকট গিয়ে পৌঁছালেন। ব্যাপক অর্থসংকটের কারণে স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ মাইকেল মধুসূদন প্রথমে ফ্রান্সের প্যারী ও পরে ভার্সাই নগরীতে যান। দেশ থেকে অর্থ না আসায় তাঁর অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে পড়ল যে, স্ত্রীর গহনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এমনকি বই পুস্তক পর্যন্ত বন্ধক রাখতে হয়। অবস্থা এমন চরম আকার ধারণ করে যে, কপর্দকহীন অসহায় অবস্থায় ঋণের দায়ে তাঁর জেলে যাবার উপক্রম ঘটে।
এই দুর্দিনেও তিনি সৃষ্টি বিমুখ ছিলেন না। বাংলা সনেট (চতুর্দশপদী) এর সার্থক স্রষ্টা কবি মধুসূদন দত্ত ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালেই ইতালির কবি পেত্রার্কের সনেট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথম বাংলা সনেটের দিগন্ত উন্মোচন করেন। ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে কবির চতুর্দশপদী কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই কবিতাগুলিতে কবি চিত্তের ব্যকুলতা, স্বদেশ প্রেমিকতা ও আবেগ ধ্বনিত হয়েছে।
নিচের চতুর্দশপদী কবিতাংশের কবি স্মরণ করেছেন জন্মভূমির কপোতাক্ষ নদের কথা

সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-মন্ত্র ধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে !
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে ?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে !
সাহিত্যচর্চা:

১৮৪৪ সালে কলকাতার "Circulator" পত্রিকায় তাঁর অনূদিত পারস্যের কবি শেখসাদীর একটি গজল "Ode" নামে প্রকাশিত হলে ইংরাজী রচনায় তাঁর প্রতিভার স্বক্ষর পরিলক্ষিত হয়।
১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ লিখিত হয় এবং বেলগাছিয়ার নাট্য শালায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এর দুই মাসের মধ্যে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং অল্পকাল পরেই ‘বুড়ো শলিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামে দুটি প্রহসন রচিত হয়। ১৮৬০ সালে রচনা করেন ‘পদ্মাবতী’, ১৮৬১ সালে ‘কৃঞ্চকুমারী’ নাটক। বাংলা নাটকের দৈন্যদশা মোচনের অঙ্গীকার নিয়েই কবি এ নাটকগুলি রচনা করেছিলেন।
বাংলা কাব্য রচনার ক্ষেত্রে কবি মধুসূধনের বিচিত্র শৈল্পিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ১৮৬০ সালে তিনি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন ‘তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য’ প্রকাশের মাধ্যমে। কবি মধুসূদনের অমর কীর্তি বিষ্ময়কর সৃষ্টি ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য। এই মহাকাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। ১৮৬২ সালে মধুসূদনের ‘বীরঙ্গনা’ কাব্য প্রকাশিত হয়। মহাকবি ‘তিলোত্তমা সম্ভব’ কাব্য, ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য- এ দুটিই সাহিত্যরস সমৃদ্ধ উল্লেখযোগ্য কাব্য। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে ধর্মীয় গোঁড়ামীর বিরম্নদ্ধে তাঁর বিদ্রোহী চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। রামচন্দ্র সম্পর্কে প্রচলিত ধর্মীয় গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে অনেক কঠিন বাণী উচ্চারণ করেছেন। এখানে ছন্দ শৈলী বিচিত্রতায় মহিমাপূর্ণ। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য থেকে :-
দৈববলে বলী যে জন, কাহারে
ডরে সে এ ত্রিভুবনে ? দেব কুলপতি
সহস্রাক্ষ পক্ষ তব; কৈলাস নিবাসী
রিরূপাক্ষ শৈলবালা ধর্ম্ম সহায়িনী !
চোখ চেয়ে লঙ্কা পানে; কাল-মেঘ সম
দেবক্রোধ আবরিছে স্বর্ণময়ী আভা
চারিদিকে ! দেবহাস্য উজলিছে; দেখ,

ধরি দেব-অস্ত্র আমি পশি রক্ষোগৃহে;
অবশ্য নাশির রক্ষে ও পদ প্রসাদে;
বিজ্ঞতম তুমি, নাথ! কেন অবহেলা
দেব-আজ্ঞা ? ধর্ম্মপথে সদা গতি তব,
এ অধর্ম্ম কার্য, আর্য্য, কেন কর আজি ?
কে কোথা মঙ্গলঘট ভাঙে পদাঘাতে ?
বিবাহিত জীবন:
১৮৪৮ সালে মাদ্রাজে অবস্থানকালে তাঁর লোকাতীত গুণে বিমোহিত হয়ে নীলকর কন্যা রেবেকা তাঁকে পরিণয়ে পাশে আবদ্ধ করেন। ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে মধুসূদন সস্ত্রীক কোলকাতায় গমন করেন। কোলকাতায় এই স্ত্রীর গর্ভে কবি মধুসূদনের এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে।
মাইকেলের করুন পরিনতি:
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অগ্রদূত বাঙ্গালী মনীষীর এক বিষ্ময়কর নিদর্শন, বাঙ্গালী তথা বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে বেনিয়াপুকুর রোডের বাড়ীতে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকেন। পাশের কক্ষে স্ত্রী প্রাণপ্রিয়া হেনরীয়েটা শয্যাশায়িনী অথচ চিকিৎসা করার মত সামর্থ তাঁর নেই। শেষ অবধি কবি আশ্রয় নিলেন অলীপুরের দাতব্য চিকিৎসালয়ে। ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে ২৬ জুন মৃত্যু শয্যায় শায়িত মধুসূদন শুনতে পেলেন স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ। তখন তাঁর চোখ গড়িয়ে পড়ে শোকাশ্রু। স্ত্রীর মৃত্যুর তিনদিন পর ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন রবিবার অপরাহ্ন প্রায় দুই ঘটিকার সময় জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত কবি মধুসূদনের জীবন প্রদীপ নিভে গেল। শেষ হয়ে গেল নিয়তি নির্ধারিত এক অভাবিত ট্রাজেডী।
বিস্তারিত জীবনী
সাগরদাঁড়ি গ্রামের প্রতাপশালী বিত্তবান ব্যক্তি রামনিধি দত্ত। তার চার ছেলে। বড় রাধামোহন, মেজো মদন মোহন, সেজো দেবীপ্রসাদ এবং কনিষ্ঠ রাজনারায়ণ। রাজনারায়ণ যশোরের উকিল ছিলেন। রাজনারায়ণ দত্ত যশোর ত্যাগ করলেন। পাড়ি জমালেন কোলকাতায়। কলকাতা সদর দেওয়ানী আদালতের ব্যবহারজীবী তিনি। যশখ্যাতি, অর্থ প্রাপ্তি ও প্রাচুর্যের মধ্যে খিদিরপুর বড় রাস্তার উপরে একটি দোতলা বাড়ি কিনলেন এবং কর্ণওয়ালিশের কৃপায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ায় সাগরদাঁড়িতে জমিদারী কিনে জমিদার হলেন রাজনারায়ণ দত্ত। সাগরদাঁড়ির গোঁড়া হিন্দুদের সমাবেশ ভরে ওঠে দত্তবাড়ির বহিরাঙ্গন। রাজনারায়ণ দত্তের জমিদারীতে বড় সুনাম। রাজনারায়ণ দত্ত সাগরদাঁড়ি আসতেন মাঝে মধ্যে।
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারী। শীতের পরশ সাগরদাঁড়ি প্রকৃতির অঙ্গ জুড়ে। হঠাৎ ভেতর বাড়ির কোণের ঘরে উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি। কাটিপাড়ার জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা জাহ্নবী দেবী আঁতুর ঘরে পুত্র সন্তান প্রসব করেছেন। এর মধ্যে কোলকাতার খিদিরপুর থেকে কর্তাবাবু রাজনারায়ণ দত্ত ফিরলেন। পুত্র ভুমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদ শুনে আত্মহারা হয়ে গেলেন। পুত্রের জন্য সোনার চেন-বুতাম, জামা কাপড়, পোশাক-আশাক, খেলনা-গাড়ী, জুড়ি-টুড়ি বজরা বোঝাই করে আনলেন। দত্তবাবু পুত্র সন্তান লাভ করায় প্রজাদের ওপর রাজস্ব হ্রাস করলেন খুশী হয়ে। বাড়িতে পুত্রের মঙ্গল কামনায় বেশ ক’দিন চললো ভোজ উৎসব। খুশী জোয়ার বয়ে চললো সাগরদাঁড়ির আকাশে-বাতাসে। বেশ কয়েকদিন কাটলো আনন্দ উৎসবে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঘটা করে ভেবে-চিন্তে নাম দিলেন মধু। শ্রী মধুসূদন দত্ত।
দিন দিন বেড়ে উঠছে সেদিনের সেই ছোট্টো শিশুটি। মধুসূদনের বাল্যকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন মাতা জাহ্নবী দেবী ও সাগরদাঁড়ি থেকে একমাইল দূরের শেখপুরা গ্রামের মৌলভী লুৎফুল হক। ভাল ফার্সী ও ইংরেজী জানতেন। রাজনারায়ণের মহলে তাঁর নিত্য আসা-যাওয়া। দত্তবাবু ভার দিলেন মধুকে শিক্ষা দিতে। মধু রামলালের সঙ্গে মাইলের বেশী পথ হেঁটে শেখপুরায় যায়। সাগরদাঁড়িতে মধুসূদন আরো একজন শিক্ষকের কাছে বাংলা ভাষা শেখেন। তিনি হলেন হরলাল রায়। হরলাল রায় ছিলেন একজন পন্ডিত। তিনি সেই সময় মধুসূদনের মধ্যে দেখেছিলেন অসাধারণ প্রতিভা। তাই হয়তো মধুসূদন সম্পর্কে বলেছিলেনঃ
“নামে মধু, হৃদে মধু, বাক্যে মধু যার,
এহেন মধুরে ভূলে সাধ্য আছে কার;
১৮৩৩ সাল। মধুর বয়স নয় বছর। দত্তবাবু মধুকে সাগরদাঁড়ি থেকে কোলকাতা নিয়ে গেলেন। খিদিরপুর পল্লীতে যশোরের গাও গ্রাম থেকে একটি রোগা শ্যামবর্ণ ছেলে গ্রাম্য আচার ব্যবহার ও মুখে যশুরে বাঙাল ভাষা। মনমরা হয়ে মায়ের আদর ও বাবার স্নেহে সাগরদাঁড়ির সমবয়সী খেলুড়েদের ছেড়ে সঙ্গচ্যুত হয়ে খিদিরপুর স্কুলে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগলো। খিদিরপুর স্কুলে কিছুদিন বিদ্যা শিক্ষার পর উচ্চতর শিক্ষর ব্যাপক প্রসার ঘটাতে রাজনারায়ণ দত্ত হিন্দু কলেজে জুনিয়র স্কুল বিভাগে মধুকে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
১৮৩৪ সাল, মার্চ মাসের ৭ তারিখ। নিউ কলেজে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভা। শেক্সপীয়ার থেকে মধু কবিতা আবৃত্তি করলেন। দৃষ্টি আকর্ষণ হোল সুধীজনের, পুরস্কার পেলেন আবৃত্তির জন্য।
১৮৩৭ সাল থেকে ১৮৪৩ সাল এই ছয় বৎসর মধুসূদন হিন্দু কলেজে পড়েছিলেন। হিন্দু কলেজের ছাত্রদের চাল-চলন পোশাকে ইংরেজ ইংরেজ ভাব। পড়াশুনায় সকলেই ভাল। কথাবার্তা চালাচালি হয় ইংরেজিতে। ক্লাসে মধু ইংরেজী বলেন। বাংলা দেখলে নাক সিটকান। বলেন, নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ আমার স্টমাক ডাইজেক্ট করতে পারে না। কিশোর মধুসূদন বিদ্রোহী। সকল নিয়মের শৃঙ্খলা তিনি মানেন না।
১৮৪১ সাল। মধুর বয়স তখন ১৭। হিন্দু কলেজের শিক্ষকগণ মধুকে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য বাছাই করেছেন। মধু পরীক্ষা দিলেন। জুনিয়ার বৃত্তি পেলেন। অসাধারণ মেধা তাঁর। হিন্দু কলেজে সিনিয়র বিভাগে ভর্তি করা হলো মধুকে। বন্ধু ভোলানাথ বলছেন, “Modu was the Jupiter.” গৌরদাস বলছেন, “------The bright stars of the college.” ভুদেবের ভাষায়, “মধুর বুদ্ধি বিদ্যুতের ন্যায় যেন চারিদিকেই খেলিত-।
১৮৪২ সাল। হঠাৎ একদিন ধুতি ছেড়ে আচকান-পায়জামা ধরলেন মধু। তারপরে একদিন সোজা সাহেবী কোট-প্যান্ট পরলেন। যে মধু সকলের কাছে একটি বিস্ময় সেই হিন্দু কলেজে সিনিয়র বিভাগে অনেকের কাছেই চক্ষুশূল।
কলেজে সিনিয়র ডিপার্টমেন্টে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। বিষয়বস্তুঃ “স্ত্রী শিক্ষা” সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখা। খবরটা মধুর কানে গেল। মধুসূদন প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় নামলেন। শীর্ষস্থান লাভ করলেন মধু। পেলেন স্বর্ণ-পদক পুরস্কার।
এই উজ্জ্বলতম তারকা বারবার হিন্দু কলেজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন বিরল প্রতিভার বিচ্ছুরণে। ইংরেজীতে একের পর এক কবিতা ছাপা হচ্ছে, ‘কমেট’, ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’, ‘লিটরারী গ্লিনার’, ক্যালকাটা লিটারারী গেজেট ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’, ‘লিটারারী ব্লোসোম (Blossom) উচ্চ মার্গের সাহিত্য পত্রিকায়।
হিন্দু কলেজে বাংলা-চর্চার কোন পরিবেশ নেই। এশিয়ার এই ভাবী মহাকবি একজন বাঙ্গালী। তাও আবার যশুরে বাঙ্গাল। তখন পর্যন্ত এক কলমও বাংলা লেখেননি তাঁর স্টমাক নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ ডাইজেক্ট করতে পারে না।
১৮৪৩ সাল। বাবা মা মধুর বিবাহের জন্য উতলা হয়ে পড়লেন। মধুর বন্ধু বান্ধবেরা কেউ কেউ ইতোপূর্বেই বিবাহ করে ফেলেছেন। গৌরদাস করেছেন, রাজনারায়ণ করেছেন, ভূদেবও করেছেন। মধু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, আচমকা নয় অনেক ভেবে চিন্তেই। তিনি না জানা মেয়ে বিবাহ করবেন না। তাছাড়া বড় কবি হবার জন্য বিলেতে যাবেন। এ সব খবর নানা মুখ ঘুরে বাবা মার কানেও পৌঁছালো। রাজনারায়ণ গৃহিণীর সঙ্গে শলা পরামর্শ করে মধুসূদনের জন্য কনে দেখে শুনে রাখলেন; পুত্রবধূ আনবেন ঘরে। মধুসূদন সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। মধূ জানালেন, বাঙ্গালী মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী নই, ওদের মধ্যে উদারতা নেই। বাবার তর্জন গর্জন, মায়ের অশ্রুমোচন সবই ব্যর্থ হলো। স্ব-ধর্ম ও স্ব-জাতির প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা। স্ব-দেশ ও দেশজ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি এবং সাহিত্যের প্রতি উদাসীনতা। বাঙ্গালী হিন্দুদের অত্যন্ত অবজ্ঞার সাথে “হিদেন” বলে ডাকা গৌরবময় হিন্দু কলেজের সতীর্থদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছিল মধুকে। তাঁর জীবনের সংকল্পের কাছে সব তুচ্ছ বন্ধু মা বাবা। ইতোমধ্যে হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হলেন এবং শোনা গেল তিনি খৃষ্টান হবেন। ফেব্রুয়ারী মাস। নয় তারিখ। আগের দিন সারারাত মধু ঘুমোননি। অস্থির চিত্ত। আজ সকালে তাঁর জীবনে এক বিপ্লবের ঝুঁকি। পিতৃ-পুরুষের সনাতন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্র্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ ওল্ড মিশন গির্জায়। গির্জার প্রধান ধর্মাচার্য আর্চডিকন ডিয়ালট্রি (Archdeacon Dealtry) জর্ডন নদীর পবিত্র বারি মধুসূদনের মাথায় সেচন করে, তাঁকে মাইকেল নাম দিয়ে দীক্ষা দেন। দীক্ষান্তে কিছুদিন তিনি গির্জার আর্চডিকন ও চ্যাপলেনের গৃহে অবস্থান করেন।
মধুসূদন যেদিন খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা নেন, সেদিন মিশন রো-তে গির্জায় চারিদিকে উত্তেজিত জনতার দৃশ্য কল্পনা করা যায়, কারণ দীক্ষা গ্রহণের আগেই তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে গির্জায় আসেন। শহরময় খবরটা আগেই রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল। শোনা গেল রাজনারায়ণ দত্ত লাঠিয়াল সংগ্রহ করে পুত্রকে ধর্মান্তর গ্রহণে বাঁধা দেবেন। জনতার উত্তেজনা দমন ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধের জন্য কর্তৃপক্ষ সেদিন গির্জার সামনে সশস্ত্র সৈনিক প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন। মধু এ সময়ে ঊনিশ বছরের উদ্যম কান্তি যুবক। তাঁর নতুন পরিচয় হলো মাইকেল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
হিন্দু কলেজের প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে গেল। অসহায় নিদারুণ। বন্ধু বান্ধব স্বজন বিহীন। কেবল হিন্দু কলেজের সর্তীর্থ গৌরদাস ও ভূদের মাঝে মধ্যে দেখা করেন মধুর সঙ্গে।
১৮৪৪ সাল। নভেম্বর মাস। হিন্দু কলেজে খৃষ্টান ছাত্রদের পড়বার অধিকার নেই। হিন্দু কলেজ ছাড়তে হলো মধুকে। বিশপ্স কলেজে ভর্তি হতে হোল বাধ্য হয়ে। ও-দিকে খিদিরপুরের বাড়ির খবর ভাল নয়। দরোজটুকু খোলা আছে। অন্দরটুকু নেই। ধর্মত্যাগে তাঁর কোন আক্ষেপ দেখা যায় না। বিধর্মী পুত্র মাকে দেখা দিতে যান। মা চোখের জল ফেলেন কিন্ত ছেলের হাতে তুলে দেন মুঠো ভরা টাকা। ধর্মান্তরিত পুত্রের পড়ার খরচ দিতেন রাজনারায়ণ। মধুর ধর্মান্তরিত হওয়ার পর তখন মাতা জাহুবী দেবী আবার তাঁকে প্রায়শ্চিও করে হিন্দু সমাজে ফিরে আসতে মিনতি করেন। তাই তাঁর পক্ষে মায়ের অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হলো না। তবুও মায়ের কথা ভোলা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। স্ব-ধর্ম-জাতি-জ্ঞাতিত্ব ত্যাগে কোন অনুশোচনা নেই। কিন্তু একমাত্র সন্তান বিধর্মী হওয়ায় জাহুবী দেবী যে মনে দুঃখ পান তাই তাকে পীড়া দেয়। তিনি মায়ের স্নেহাশ্রয়ে বড় হয়ে ওঠেন। মধুর শৈশবে তিনটি প্রভাব তাকে ভাবিয়েছে-একটি সাগরদাঁড়ি গ্রাম ও কপোতাক্ষ নদ অন্যটি তার মায়ের প্রতি অপরিসীম মমত্বেবোধ।
পরপর আরো দু’টি পুত্র সন্তান হারাবার পরে মাতা জাহুবী দেবীর সকল আশা ভরসার প্রতীক মধূসূদন। জাহুবী দেবীর প্রসন্ন ও মহেন্দ্র নামে দু’টি সন্তান ছিল। কিন্তু তাদের অল্প বয়সে মৃত্যু ঘটে। ফলে একমাত্র পুত্রের ধর্মত্যাগে তিনি শুধু মর্মাহত হননি, একেবার নিসঙ্গ হয়ে পড়েন। নিদারুণ মনোকষ্টে ভেঙ্গে পড়েন মাতা জাহুবী।
মধু চিরকালই পড়ুয়া; বন্ধুরা বলতেন, গ্রন্থকীট। এখানে এসে লেখাপড়ার প্রচুর সুযোগ পেলেন তিনি। ভবিষ্যতে মহাকাব্য লিখতে হলে অগাধ শিক্ষার প্রয়োজন। এইখানে তিনি প্রাচীন ভাষা সাহিত্য গ্রীক, লাতিন এবং হিব্রু ভাষা শিক্ষা করে এবং কুমার স্বামীর নিকট সংস্কৃতও দীক্ষা লাভ করেন।
খৃষ্টের সকল সন্তান সমান; কিন্তু পাদরীদের সব ছাত্র সমান নয়। বিশপস কলেজে পোশাকে পরিচ্ছদে, খাদ্যে-পানীয়ে সাদা-কালো প্রভেদে বিদ্রোহী মধুসূদন রীতিমত ক্ষেপে গেলেন। কলেজে পড়তে পড়তে কালো চামড়ার নিকৃষ্ট জীবদের সঙ্গে সাদা চামড়ার উৎকৃষ্ট জীবদের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য বললেন,“হয় আমাকে কলেজী পোশাক পরতে দাও, না হলে আমি আমার জাতীয় পোশক পরব।” কলেজ কর্তৃকপক্ষে চটে গেলেন। নাম কেটে দিতে চেয়েছিলেন মধুর। শেষ-মেষ কর্তৃপক্ষ মধুকে কলেজের সাধারণ পোশাক পরার অনুমতি দিলেন। কলেজের বাইরে মধুসূদন অভ্যাসমত ইংলিশ কোট ও বীভার হ্যাট পরে চলাফেলা করতেন।
সময়টা ভাল কাটছে না মধুর। শোনা যাচ্ছে রাজনারায়ণ দত্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবেন। রাজনারায়ণ দত্ত একমাত্র পুত্রের একগুয়েমী উচ্ছৃঙ্খলায় অর্থ সাহায্য বন্ধ করলেন। মধুসূদন নিদারুণ দূরবস্থার মধ্যে হতাশায় কাটাতে লাগলেন। মায়ের কাছে টাকা চাইবারও মুখ নেই। বই-পত্র বিক্রী করে হাত খরচ চালাতে হচ্ছে। বার বার সাগরদাঁড়ির কথা মনে পড়ে। সেই বাদাম তলে, কপোতাক্ষ নদ, আমবন, শেখপুরার মৌলভী শিক্ষক, জাহ্নবী দেবীর মুখ, ভাঙ্গা শিব মন্দির।
মধুসূদন সাগরদাঁড়ি এলেন। অনেকদিন মায়ের মুখ দ্যাখেননি, সেই মা-। জননী জন্মভূমি। নৌকা থেমে নেমে নদীকে দেখে নিলেন। স্বচ্ছ সলিল নদ। শ্যামল মাঠের বাঁকা পথ ধরে বাড়ি গেলেন মধুসূদন। খবর শুনে জাহ্নবী দেবী কেঁদে ফেল্লেন। কথা কইতে পারলেন না। পাশের ঘর থেকে কাকীমা- খুড়ীমা রামলালকে শাসালেন। নিরুপায় রামলাল নির্দেশমত সদর দরজা বন্ধ করে দিল। মধু সদর দরজার বাইরে থেকে আস্ফালন। অন্তঃপুরের আঙ্গিনায় জাহ্নবী দেবী কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। আর মধু বাইরে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন। রামলাল জাহ্নবী দেবীকে বলছেঃ মা ঠাকরুণ মধু বাবুকে ডেকে আনবো? রামলাল বাইরে এসে দেখে মধুসূদন নেই। সমাজপতিদের জাত গেল দেখে হিন্দু সমাজের প্রতি মধুসূদনের মনে আরো একবার তীব্র খেদ জন্মালো। মাতৃদর্র্শন থেকে বঞ্চিত মধুসূদন আবার কলকাতা ফিরলেন।
১৮৪৭ সাল। ২৪ ডিসেম্বর। অকূলে ভাসতে ভাসতে মাদ্রাজ বন্দরে এলেন। অনেক কষ্টে পাথেয় সংগ্রহ করে কিছু দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধু-বান্ধবদের সহায়তায় এই অনিশ্চিত পথযাত্রায় পা বাড়ালেন মধুসূদন। বিলাত যাওয়া হলো না। বিলাতে যেতে হলে জাহাজে ভাসতে হয়।
মাদ্রাজ বন্দরে জাহাজে চারদিন কাটালেন। সমুদ্র যাত্রায়-দুঃখ, যাতনা ও হতাশায় মধুর জ্বর এল। অবশেষে, বন্দর থেকে মাদ্রাজ পৌঁছে গেলেন মধু। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই। মাদ্রাজের পথে পথে মধু ঘুরছেন ভাগ্যান্বেষণে, কিন্তু ভাগ্য তাঁর বড় একটা সহায় হলো না। এসে উঠলেন ব্লাক টাউনে। অসুস্থতা আরো বাড়লো। ব্লাক টাউনের মেডিক্যাল অফিসার মিঃ ডেভিডসনের চিকিৎসায় এবং দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধু বান্ধবদের সহায়তায় তিনি ধীরে ধীরে নিরাময় হয়ে উঠলেন।
অনেক ঘোরাঘুরির পর অবশেষে ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন হলো মধুর ওপর। কাজ জুটলো। একটা গরীব স্কুলের ছোট শিক্ষক। নাম হচ্ছে ‘মাদ্রাজ মেল এ্যাসাইলাম ফর দি চিলড্রেন অব ইউরোপীয়ান অ্যান্ড দেয়ার ডিসেনডানস।’ পদটি ইংরেজী শিক্ষকের। মাদ্রাজে তখন মিশনারীদের বেশ তৎপরতা। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন দেশীয় খৃষ্টান ও এ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়। ব্লাক টাউন থেকে স্কুল যাতায়াত করছেন। যাওয়া আসার পথে ‘মাদ্রাজ সার্কুলেটর” পত্রিকার কার্যালয়। একদিন ঢুকে পড়লেন সেখানে। দু’একটি কবিতা দিলেন। ছাপা হলো। এবার তিনি আর স্ব-নামে লিখছেন না। লিখছেন ছদ্ম নামে টিমোথী পেন পোয়েম নামে। এইভাবে ধীরে ধীরে শিক্ষক, সাংবাদিক এবং কবি হিসেবে তিনি সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করছেন।
সাগরদাঁড়ির প্রতাপশালী জমিদারের একমাত্র দুলাল একজন স্কুল মাস্টার। ধর্ম বিবর্জিত অনাথ মাস্টারটির বছর তিনেক চলছে মাদ্রাজে। একদিকে আছে মাস্টারী মধুসূদনের ভাষায় ‘নকীব’ আর অন্যদিকে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে জমিদার নন্দনের দিন-আনি দিন খাই। অবস্থা জোরবার। বিশেষ কার্যসূত্রে একবার কোলকাতা আসার প্রয়োজন দেখা দিল তাঁর। মধু কোলকাতার কবি। কোলকাতা তাঁকে কাছে টানছে। কিন্তু পাথেয় নেই। কয়েকদিন আগে মমতাময়ী মা ইহধাম ত্যাগ করে চলে গেছেন। তিনি সে খবর পাননি। খবর যখন কানে গেল তখন শ্মশানের চিতায় চন্দন কাঠের ধূসর ছাইমাটি বাতাসে উড়ছে। মধু কোলকাতায় এলেন গোপনে-গেলেন গোপনে-বন্ধুরা পর্যন্ত কেউ জানলো না। শুধু পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো তাও নিভৃতে। প্রচন্ড এক বিয়োগ ব্যথায় মধুর দেহ মনে বিষাদের ঘন কাল ছায়া।
মাদ্রাজ ফিরলেন। ‘হিন্দু ক্রোনিকল’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনার ভার নিলেন এ-সময়। ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া এই খবর উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, “ওই কাগজে প্রকাশিত কয়েকটি ইংরেজী কবিতা সেই সময় বাংলাদেশের ‘হরকরা’ ও ‘ইংলিশ ম্যান’ পত্রিকায় পুনঃ মুদ্রিত হয়। এর অনেক আগেই ঊনপঞ্চাশ সালের এপ্রিলে ‘দি ক্যাপটিভ ল্যাডি’ প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত কাব্যের সঙ্গে ‘দি ভিশন অব দি পাস্ট’ নামক একখানি অসম্পূর্ণ কবিতাও প্রকাশিত হয়। ‘ক্যাপটিভ ল্যাডি’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই মধুসূদন প্রত্যাশা করেছিলেন যে, ‘ক্যাপটিভ ল্যাডি’ বাংলাদেশে তুমুল হৈচৈ তুলবে। কিন্তু বিষ্ময়ের ব্যাপার এই যে, বাংলাদেশে সবশুদ্ধ আঠারো খানা বই বিক্রি হলো। নিরাশ হলেন মধুসূদন।
‘ক্যাপটিভ ল্যাডি’ মাদ্রাজে প্রকাশিত হলো কিন্তু কোলকাতায় সমাদৃত হলো না। মাদ্রাজ থেকে মধুসূদন গৌরদাস মারফৎ তৎকালীন শিক্ষা সচিব বেথুন সাহেবকে একখানা কাব্য পাঠিয়ে দিলেন উপহার হিসেবে। বেথুন সাহেব ‘ক্যাপটিভ ল্যাডি’ মধুসূদনকে মাতৃভাষায় কাব্যরচনা করতে উপদেশ দেন। ভিন্ন জাতীয় ভাষায় কবি প্রতিভার সম্যক প্রকাশ সম্ভব নয়। গৌরদাসও বন্ধুকে বাংলা কাব্য রচনায় উৎসাহিত করেন। বেথুন সাহেব ও গৌরদাসের অনুরোধ মধুসূদনকে অন্য পথের সন্ধান দেয়।
১৮৫৪ সালের ডিসেম্বর। মধুসূদন মাদ্রাজের একমাত্র দৈনিক পত্রিকা ‘স্পেকটেটর’ এর সাব-এডিটর নিযুক্ত হলেন। এই মাদ্রাজেই মধুসূদন সাহিত্যের মণিমালা চয়ন করেন হিব্রু, গ্রীক, সংস্কৃত, জার্মান, ফার্সী, তেলেগু, লাতিন ও ইংরেজী ভাষার সাহিত্য ভান্ডার থেকে। ভয়াবহ অর্থ সংকট চলছে দরিদ্র স্কুল মাস্টারের। কেবল কলম হলো আয়ের উৎস। মেল অফার্ন এ্যাসাইলাম এর ‘নকীব’ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন মধুসূদন। জর্জ নটার্ন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি। ভস্মাচ্ছাদিত হলেও আগুন চিনে নিতে তাঁর ভূল হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইস্কুল বিভাগে সেকেন্ড মাষ্টারির পদ দিয়েছেন তাঁকে। পদটি লোভনীয় ও সম্মানজনক। কিছুটা সোয়াস্তি এল এবার।
১৮৪৮ সনের ৩১ জুলাই মিঃ নেলর রেবেকা-মধুর বিবাহের যোজকস্বরূপ ছিলেন। এই বিবাহে বালিকা রেবেকার আত্মীয় স্বজনের আপত্তি ছিল। ফলে শিক্ষিত মহল এবং পন্ডিত সমাজ মিঃ নেলর এর সহযোগিতায় সে বাঁধা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন এবং বিবাহ কার্য সম্পাদন করাতে সমর্র্থ হন। মাতৃহারা এই মহিলা জীবনে কোন দিন আর্থিক অনটনের সম্মুখীন হননি। অসাধারণ রূপসী রেবেকা সকল প্রকার সুখ থেকে কখনও বঞ্চিত নয়। এ সময় মধুর সামান্য আয় রেবেকার চাহিদা মেটাতে সমর্থ হয়নি হয়তো ঠিক নয়। দারিদ্র জর্জরিত, চির ক্রদনরত, ধর্মবিবর্জিত, অস্থির চিত্ত, অব্যবস্থাচিত্ত, অমিতব্যয়ী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মাইকেল শ্রী মধুসূদন দত্তের দাম্পত্য জীবন রেবেকার অসহিঞ্চু মনোভাবে জীবনের দিনগুলি অতীব বিষময় করে তোলে। মাদ্রাজে ছিলেন আট বছর। রেবেকার সংগে ঘর করলেন সাত বছর। গৌরদাসের কাছে মাদ্রাজ থেকে শেষ চিঠিতে লিখলেন “YES Dearest Gour, I have a fine English wife, and four children.”
অন্যদিকে প্রবাস জীবনে মাতৃভাষা ভুলে যাবার বেদনায় মধুসূদন বুঝতে পারলেন ভিন্ন জাতীয় সমাজে আপন ভাষা ও কৃষ্টির মূল্য কত। সংঘাতময় দাম্পত্য জীবনে রেবেকা ম্যাকটাভিসের গর্ভে দুই পুত্র ও দু’টি কন্যা সন্তান জন্মেছিল। বেঁচে ছিল মাত্র এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তান। বিচ্ছেদেও রূপোর নৌকা বেয়ে জীবন নদীর তীরে উঠবার অতৃপ্ত দুর্নিবার প্রেমকাঙ্খা নিয়ে মধূ মাদ্রাজ ত্যাগ করলেন। কিন্তু মধু যেদিন সাগরদাঁড়ি থেকে পা বাড়িয়েছেন সেদিন থেকে তাঁর বিধি বাম।
১৮৫৫ সালের ১৬ জানুয়ারী সাগরদাঁড়ির জমিদার রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর মর্মজ্বালা থেকে মুক্তি পেলেন। পিতার মৃত্যু সংবাদ প্রবাসে বিলাস বহুল জীবনে সামান্য আয়ে নিদারুণ অর্থ সংকট তাকে উদভ্রান্ত করে তোলে। মধুসূদন একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি এলেন কপর্দকহীন অবস্থায়। চারচারটি সন্তানসহ জননী রেবেকা জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন। মধুসূদন গৌরদাসের বাড়িতে থাকলেন কিছুদিন। গৌরদাস পঞ্চাশটি টাকা দিয়েছেন হাত খরচের জন্য। বন্ধু গৌরদাস ও ভূদেব কোলকাতায় মধুসূদনকে অভ্যর্থনার জন্য এক সান্ধ্য ভোজের আয়োজন করলেন। সেই ভোজসভায় কিশোরী চাঁদ মিত্র, দিগম্বর মিত্র প্রমুখের উপস্থিতি ঘটে। বন্ধু কিশোরী চাঁদের কৃপায় পুলিশ অফিসে সামান্য একজন কেরানীর চাকরী জুটলো। মাইনে মাত্র চল্লিশ টাকা। অকূলে কূল পেলেন মধুসূদন।
ইতোমধ্যে মধুসূদনের অনুপস্থিতির সুযোগে স্বার্থন্বেষী মহল তাঁর পৈাত্রিক সম্পত্তি জাল উইল তৈরী করে মধুসূদনকে মৃত বলে রটনা করে। সেই পৈতৃক সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে মধুসূদনকে যথেষ্ট অসুবিধেয় পড়তে হয়। অবশেষে প্রিয় বন্ধু ভোলানাথ গৌরদাস মনমোহন ও রাজনারায়ণ বসুর চেষ্টায় সম্পত্তির কিছু অংশ উদ্ধার হল।
ইতিমধ্যে হেনরিয়েটা এলেন। ছয় নম্বর লোয়ার চিৎপুরে সংসার গড়ে তুললেন একটি বাসাবাড়ি নিয়ে। বছর ছয়েক চললো। চল্লিশ টাকা মাইনের জুডিশিয়াল ক্লার্কটির পদোন্নতি ঘটলো দোভাষী পদে। ম্যাজিষ্ট্রেট কিশোরীচাঁদ মধুসূদনকে একশ বিশ টাকা মাইনে করে দিলেন। মধুসূদন ও কিশোরীচাঁদ ছিল ঘনিষ্ট বন্ধু। অথচ বিপুল ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত বিদ্রোহী মধুসূদনের ধারণা বছরে অন্ততঃ চল্লিশ হাজার টাকা ব্যয় না করলে ভদ্রলোক হওয়া যায় না। হায়রে নিয়তি! সেই মধুসূদন সামান্য মাইনেতে চাকরী করছেন। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস !
১৮৫৮ সাল। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের যুগান্তর সৃষ্টির এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। কৃপণের মত সঞ্চয় করতে চাননি, বরং দু’হাতে মুঠি মুঠি টাকা বিলিয়ে দিয়েছেন। যিনি কখনো গাড়ী চড়ে গাড়োয়ানকে গুনে টাকা দেননি, হাতের মুঠোয় যা উঠেছে তাই দিয়েছেন। চুল কেটে নাপিতকে এক মোহর করে বকশিশ দিয়েছেন। সেই মধুসূদনের অর্থাভাবে নিদারুণ দূরবস্থা। নিঃস্ব অসহায় সমাজ বন্ধনহীনদুর্দশা গ্রস্থ জীবন যাপন। দিনরাত মদ্যপান ও গ্রন্থপাঠ। আর নিয়মিতভাবে পুলিশ অফিসের দোভাষীর চাকরিটা বজায় রাখেন জীবনের তাগিদে। এ সময়ে মধুসূদনের পড়ার ঘরে থাকতো হোমার, দান্তে ট্যাসো, মিল্টন, বায়রন ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের সব বইপত্র।
গৌরদাস নাটক অনুবাদের কথা বলতেই মধুসূদন তা নাকচ করে দেন। তাঁর ধারণা চাঁড়াল মুচি ও মেছুনীদের ভাষা হলো বাংলা, তিনি করবেন বাংলা নাটকের ইংরেজী অনুবাদ! গৌরদাস একটি মোড়ক খুলে বইটির কপি তুলে দিলেন মধুর হাতে। মধুসূদন বইটির কয়েক পাতা নেড়ে চেড়ে বইটি গৌরদাসের কোলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেন, প্লীজ ফরগীভ মী। গৌরদাস বার কয়েক মধুকে নাটকটি ট্রানশ্লেট করার অনুরোধ জানালেন এবং বেলগাছিয়া নাট্যশালায় মহড়া দেখতে আমন্ত্রণ করলেন। গৌরদাস মধুকে বল্লেন, এই নাটকটি অনুবাদ করলে রাজারা পাঁচশো টাকা অনারেরিয়াম দেবেন বলেছেন। মধুসূদন এ সময়ে উল্লাসে ফেটে পড়েন।
এরপর মধুসূদন নিয়মিত বেলগাছিয়া ভিলায় আওয়ার ওউর ক্লাবে যাতায়াত শুরু করেন এবং সদস্য হয়ে গেলেন। মহড়া দেখেন। অবিলম্বে রত্নাবলী নাটকের অনুবাদ সাঙ্গ হয়ে গেল। বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে তা মঞ্চস্থ হলো। রাজাদের নাটকটি বেশ পছন্দ হলো। কিন্তু মধুসূদন সকলকে শুনিয়ে বলতে লাগলেন, বিপুল অর্থব্যয় করে এমন নাটক করার কোন মানে হয় না। আমি যদি আগে জানতাম, আমি তোমাদের নাট্যশালার জন্য উপযুক্ত নাটক লিখে দিতাম।
হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে লিখতে শুরু করলেন। শর্মিষ্ঠা দেবযানী আখ্যান নিয়ে মহাভারতের কাহিনী ঘেটে নাটক ফাঁদলেন। গৌরদাস এর কিছু অংশ পাঠ করে বিষ্ময়ে বিমুগ্ধ হন। মধুসূদন এ সময়ে বাংলা সাহিত্যে আকষ্মিকভাবে নবজাগৃতির ঝড় তোলেন এবং তা হিন্দু সমাজে ক্ষোভ ও বিদ্রোহের ডামাডোলে রীতিমত উত্তাল হয়।
একদিন বেলগাছিয়া ভিলার একটি কক্ষে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মধুসূদন বসে ছিলেন। সেখানে প্রতাপ চন্দ্র সিংহ, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, গৌরদাস ও অন্যান্যরা বাংলা নাটক ও কবিতা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। হঠাৎ পুলিশ কোর্টের কেরানীটি বলে ফেললেন, অমিত্রাক্ষর ছন্দেই একমাত্র বাংলায় সার্থক ও দৃঢ় সংবদ্ধ কবিতা রচিত হতে পারে। মধুসূদন সগর্বে আরো বললেন, যদি কেউ পারে তো একমাত্র একজনই পারবে। আমি ছাড়া আর কেউ নয়। যতীন্দ্রমোহন বললেন, আপনি লিখবেন? তা হলেই সে বই মুদ্রণের ব্যয়ভার আমিই বহন করবো। কয়েকদিনের মধ্যেই মধুসূদন ‘তিলেত্তমা সম্ভব’ নামে একখানা কাব্য লিখে ফেললেন।
মধুসূদনের কবি মানসে যে শর্মিষ্ঠার জন্ম, কন্যা শর্মিষ্ঠার জন্ম তাঁর অনেক পরে। শর্মিষ্ঠা নাটক ও কন্যা শর্মিষ্ঠার আবির্ভাব প্রায় একই সালে। আঠারো শো ঊনষাট। কন্যার নাম হেনরিয়েটা এলিজা শর্মিষ্ঠা।
এ দিকে আঁতুড় ঘরে বাংলার মেঘনাদ উঁকি দিচ্ছে। এই মেঘনাদই মাইকেল পুত্র। যার নাম ফ্রেডারিক মাইকেল মিল্টন দত্ত। হেনরিয়েটার প্রথম পুত্র সন্তান এই মিল্টন পিতার ন্যায় অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিল। মাত্র তের বৎসর বয়সে সে ফরাসী ও ইংরেজী ভাষায় যথেষ্ঠ জ্ঞান অর্জন করেছিল। চিত্রাঙ্কন করতো সুনিপুণভাবে। নিজের হাতে জননী হেনরিয়েটার ছবি এঁকেছিল অবিকল। পিতার ন্যায় মিল্টন ইংরেজীতে দক্ষ কবিতা লিখেছিল। কৃত্তিবাসের মেঘনাদের মত কবির মেঘনাদও মৃত্যুবরণ করলো বালক বয়সে। বেশীদিন পৃথিবীর আলো-বাতাস ভোগ করতে পারলো না। মাত্র তের বছর দশ মাস ঊনিশ দিন পৃথিবীর আলো-বাতাসে ছিল মিল্টন। মিল্টনের মৃত্যু মধুকে নিস্তব্ধ করে দিল। হেনরিয়েটা উদভ্রান্ত হয়ে গেলেন। পুত্র শোকে কাতর দম্পতি দিন-রাত একে অন্যকে সামলে চলতে লাগলেন। শর্মি ও মিল্টন ছাড়াও মধুসূদনের আর একটি পুত্র সন্তান ছিল হেনরিয়েটার দিকের। তার নাম ছিল আলবার্ট নেপোলিয়ান দত্ত।
হেনরিয়েটা। আশ্চর্য এই ফিরেঙ্গী বিদেশিনী। স্বামীর কাছ থেকে ইংরেজী ও বাংলা ভালোই শিখেছিলেন। ক্যাথলিক ধর্মযাজক দিয়ে স্বীকৃত বৈধ বৈবাহিক স্ত্রী রেবেকা চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল হেনরিয়েটা থেকে ভিন্ন। এই ফরাসী কন্যা হেনরিয়েটার সঙ্গে মাইকেলের কোন আইনানুগ বিয়ে হয়নি। তবু মাইকেল তাঁকে হৃদয় উজাড় করে গভীর ভালবাসা দিয়ে রাখতেন। বুদ্ধিমতি হেনরিয়েটা জানতেন এই পুরুষ সিংহকে কোনদিন শাসিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা যাবে না। তাই গুনবতী আঁরিয়েতা গুণ নৈপুণ্য কবিকে মুগ্ধ করতেন। অসামান্য কর্ম-নৈপুণ্যে কবিকে সংযত করার চেষ্টা করতেন।
এই রেবেকার মধ্যে মধুসূদন তাঁর অবচেতন মনের কল্পনায় নারীকে খুঁজে পাননি যা আঁরিয়েতের মধ্যে পেয়েছিলেন। হেনরিয়েটার মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন শিক্ষিতা, সুরুচিসম্পন্না, অসীম ধৈর্যের অধিকারী, সহানুভূতিশীল প্রেয়সীকে। মাইকেলের বিপুল অর্থ, বিবেচনাহীনভাবে ব্যয়, দারিদ্র ও দুর্দশার মধ্যে হতাশাময় দিন হেনরিয়েটা হাসিমুখে সহ্য করেছিলেন।
১৮৬১ সাল। সোনালী সকাল। শীতকাল। জানুয়ারী মাস। বাংলা সাহিত্যে মহাকবির “মেঘনাদ বধ কাব্য” মহাকল্লোলের ধ্বনি তুললো। জোয়ারে জোয়ার তুললো কলকাতা তথা ভারতবর্র্ষে। যশোরের রাজনারায়ণ দত্তের কুপুত্তর খেষ্টান মধুর আহা কি যশ! মেছো চাঁদনি, মুদি দোকান, রাজা মহারাজাদের অন্তঃপুরে সর্বত্র মেঘনাদ বধের করুণ রাগিনী। একদিন এক মেছো দোকানে আলাপ হচ্ছে মধুর মেঘনাদ বধ কাব্য নিয়ে। দোকানদার বলছেঃ লিখেছে বেশ, কার লেখা গো?
-খেষ্টান মধুর। জাত খোয়ানো ট্যাঁশ ফিরিঙ্গী মধুসূদন দত্ত।
-যশোরের রাজনারায়ণ দত্ত। তাঁর কুপুত্তর যীশু ভজেছে।
-কিন্ত লিখেছে বেশ।
দোকানদার আবৃত্তি শুরু করলোঃ
“সুমিত্রা শ্বাশুড়ী মোর বড় দয়াবতী ;
কে বলে ধরিয়াছিলা গর্ভে তিনি তোরে।”
বারই ফেব্রুয়ারী একষট্টি সাল।
কালী প্রসন্ন সিংহ “বিদ্যোৎসাহিনী সভার” পক্ষ থেকে মধুসূদনকে সম্বর্ধনা জানাবার জন্য মঞ্চের আয়োজনে ব্যস্ত। সম্বর্ধনা সভায় উপস্থিত রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, রামপ্রসাদ রায়, কিশোরী চাঁদ মিত্র, পাদরী কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, গৌরদাস বসাক প্রমুখ। মঞ্চে সকলের মধ্যে উপবিষ্ট ট্যাঁশ ফিরিঙ্গী শ্যামকাল শ্রী মধুসূদন দত্ত। গভীর আয়ত চোখ, কুঞ্চিত চুল, জর্জীয় দাঁড়ি-গোফ, হ্যাটকোট পরা। গৌরদাস তার সুললিত কন্ঠে সুদর্শন বপু নেড়ে মহাকবি স্বীকৃত ঘোষণা দিয়ে মধুকে মঞ্চে আহ্বান করলেন এবং অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, “মান্যবর শ্রীল মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাশয় সমীপেষু। বাঁধাই করা মানপত্র ও একটি পানপত্র উপহার দিলেন সভার পক্ষ থেকে।
এ সময়ে মার্চ মাসে পাদরী লঙ সাহেবের ভূমিকাযুক্ত হয়ে নিষিদ্ধ দু'শো পৃষ্ঠার “নীলদর্পণ” নাটকের অনুবাদ মাত্র একরাতে সম্পন্ন করেন ইংরেজীতে। তারপর স্ত্রী হেনরিয়োটাকে ডেকে বল্লেনঃ ডার্লিং এস দেখবে। নীলকরদের অত্যাচারের এক অপূর্ব দর্পণ। By A Native ছদ্ম নামে লিখেছি। এই গ্রন্থে আমার কোন নাম থাকছে না। ইউরোপকে জানাতে হবে, এখান থেকে যতবাক্স নীল ইউরোপে যাচ্ছে তা প্রত্যেকটি রক্ত চিহ্নিত। লন্ডনের সিম্পফিন মার্শাল নামে একজন প্রকাশক এই নীলদর্পণ নাটক প্রকাশ করেন।
এ সময়ে জুন মাসে ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য দ্বিতীয় খন্ড পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। বই লিখে যশ: খ্যাতিতে এ সময়টা বেশ ভালই কাটছিল। চারদিকে সকলেরই কৌতূহল কে এই মাইকেল।
পিতৃসম্পত্তি নিয়ে দীর্ঘকালের বিবাদ মিটিয়ে বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় সাংসারিক সচ্ছলতায় মধুসূদন ডুবে আছেন। সাগরদাঁড়ি জমিদারী, খিদিরপুরের বাড়ি সবই এখন তাঁর। হাতে এখন রাশি রাশি টাকা। রাতদিন কাজ-কর্মে ডুবে থাকেন মধু। সংসারে সুখের অন্ত নেই। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আরাম আয়েশে আছে। জমিদারী দেখা-শোনা, কাব্যচর্চা, সাচ্ছন্দ্যময় গতিশীল জীবন।
১৮৬২ হেনরিয়েটা স্বামীকে বল্লেনঃ তোমার জন্মস্থান সাগরদাঁড়ি একটি নাইস বেঙ্গলী ভিলেজ। আমার দেখতে বড় সাধ হয়। তোমার ছেলেমেয়েরা তোমার জন্মস্থান দেখলো না। শর্মি ও মিল্টন সাগরদাঁড়ির কথা বলে। মধুসূদন আনন্দে আঁরিয়াতকে জড়িয়ে ধরে বললেনঃ আমার জন্মস্থান দেখবে। চল ডার্লিং, সাগরদাঁড়ি।” মধুসূদন এ সময়ে আনন্দে অশ্রুসজল হয়ে উঠলেন। কোলকাতা থেকে স্ত্রী-কন্যা-পুত্র সহ যশোরের ঝিকরগাছা এলেন। ঝিকরগাছা বোটঘাট থেকে একখানি বজরা নিলেন সাগরদাঁড়ি। দু’তীরে ছোট ছোট গ্রাম। গাছপালা ঝোঁপঝাড়। সেই শৈশব। মধুসূদন উদ্বেল হয়ে উঠলেন। বজরার ছাদে হেনরিয়েটার কোলে দুধের শিশু মিল্টন। মধুসূদনের চোখে পানি টলমল করছে। মিল্টন ক্ষিদেয় কাঁদছে। পথে ত্রি-মোহনীতে বজরা ভিড়ালেন দুধের জন্য। গায়ে আলেস্টার, মাথায় হ্যাট-হাতে ছড়ি। বজরা থেকে নেমে মধুসূদন গ্রামে গেলেন। ভয় পেয়ে গাঁয়ের লোক পালাতে লাগলো। তখনো দেশে ভয়াবহ নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের রেশ কাটেনি। হয়তো গ্রামবাসী ভেবেছিল ট্যাশ ফিরিঙ্গী নীলকর সাহেব। মধুসূদন হতহ্বিল হয়ে গেলেন গ্রামবাসীকে হাত বাড়িয়ে ডাকতে লাগলেন। গ্রামবাসী মধুর ডাকে সাড়া দিল মিল্টনের জন্য অনেক দুধ দিয়ে। গ্রামবাসী বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল সাগরদাঁড়ির প্রতাপশালী জমিদার রাজনারায়ণ দত্তের একমাত্র পুত্র ক্রিশ্চিয়ান মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তাদের মধ্যে পেয়ে। তারা এত দুধ নিয়েছিল যা দিয়ে রীতিমত একজন লোক নাইতে পারতো।
বজরা এগিয়ে চলেছে সাগরদাঁড়ি। মধুর মনে শৈশব স্মৃতি ভেসে উঠতে লাগলো। সেই চিরচেনা মাঠ, বাদামতরুর ঘাট, ভাঙ্গা শিব মন্দির, চন্ডিমন্ডপ, শৈশবের গাইড রামলাল, মাতা জাহ্নবী দেবী, শেখপুরা সাগরদাঁড়ির মৌলভী শিক্ষক আরো কতো কি। মনে হচ্ছে কোন রাজ্য জয়। আনন্দ অশ্রু বাঁধ ভেঙ্গে আসছে। মধুসূদন হাটের কাছে ওই ঘাটে বজরা ভিড়িয়েছিলেন। জনশূন্য পথ-ঘাট। বিদেশিনী স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মধু ধীর শান্তভাবে হেটে যাচ্ছেন। নিশ্চুপ মধুকে হেনরিয়েটা শুধালেনঃ পোয়েট ভেরী নাইস। তোমার জন্মস্থান সাগরদাঁড়ি। আই লাভ দিজ কিউট লিটল বেঙ্গলী ভিলেজ। ইতিমধ্যে মাঠ পেরিয়ে পুকুর ঘাটের আমতলার আঙ্গিনায় এসে গেছেন মধুসূদন। মধুর জ্যাঠতুতো ভাই আনন্দমোহন চেচিঁয়ে পাড়ামাত করছে। আমাদের মধু এসেছে গো-মা ঠাকুরণ তোমরা কোথায় গেলে? ছেলেমেয়ে নারী-পুরুষ জড়ো হয়েছে রাজনারায়ণ দত্তের বাড়িতে। মাদ্রাজে থাকতে মধুর মৃত্যু সংবাদ রটে গিয়েছিলো। সেই মধু সপরিবারে এসেছে। লোকজনের কৌতূহলের শেষ নেই। গাউন পরা শ্বেতাঙ্গিনী হেনরিয়েটার দিকে চেয়ে গা টিপে অনেকে হাসছে। হেনরিয়েটা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলছেঃ কত বড় বাড়ি !
- মুন্সি রাজনারায়ণ দত্তের প্রাসাদ। সাত গাঁয়ের লোকে দেখতে আসতো বলে মাইকেল হেনরিয়েটাকে ছেলেবেলার স্মৃতিকথা শোনাতে লাগলেন। আনন্দমোহন একখানা চেয়ার এনে হেনরিয়েটাকে বসতে দিল। মধু আনন্দের কাছে চাষ-আবাদের খবর, খুড়ীমা, জেঠিমার খোঁজ-খবর নিতে লাগলেন এবং বিমাতা বয়সের ছোট প্রসন্নময়ীকে ডেকে বল্লেনঃ মা কোথায়? তোমায় দেখতে বউকে নিয়ে এলাম। শাঁখ বাজাও, বউ-এর সিথেয় সিদুঁর পরাও, বরণ কর, উলু দাও। হেনরিয়েটা প্রসন্নময়ীর পায়ে প্রণাম দিতে যাচ্ছেন। প্রসন্নময়ী পিছিয়ে গিয়ে বল্লেনঃ ছুঁয়ো না, এখন আমি নাইতে পারবো না। ছুঁলে জাত যাবে। আনন্দ তোর দাদাকে বলঃ আমি বিধাব মানুষ। ওদের ঘরে নিয়ে বসতে দিয়ে জাত খোয়াতে পারবো না। আমার শুচিতা পবিত্রতা মেনে চলতে হয়।
হেনরিয়েটা প্রসন্নময়ীর কাছে প্রতি মাসে ঠিকমত টাকা পাচ্ছেন কিনা, শরীর স্বাস্থ্য ইত্যাদির খোঁজ-খবর নিতে লাগলেন। কিন্তু প্রসন্নময়ী কথার কোন উত্তর করলেন না। আনন্দকে ডেকে বললেনঃ রান্নাঘরে কলাপাতা আছে। ওদের খেতে দে। মেটে কলসী আছে-জল এনে দে। এ সময়ে মধু বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যান। হেনরিয়েটা মধুসূদনের বাহু জড়িয়ে ধরে বিষ্মিত বিষ্ময়ে মুখপানে চেয়ে থাকেন। মধুসূদন এ সময়ে স্মিত হেসে বল্লেনঃ অথচ আসলে এ বাড়িটা আমার।
আনন্দের দেয়া ভাত উঠোনে বসে কলাপাতায় খেয়ে মধুসূদন নিজ হাতে পাতা তুলে পুকুরে হাত-মুখ ধুয়ে নিলেন। বাইর বাড়িতে মধুসূদন দিন কয়েক কাটালেন। খেতেন মুসলমান পাড়ায়- এ বাড়ি সে বাড়ি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কোলে তুলে শত দুঃখের মধ্যেও বলতেনঃ আয় বেটা আমার মুখের এঁটো খাইয়ে তোদের জাত মেরে দিই।
এরপর কিছুদিনের জন্য মধুসূদন গেলেন রাড়–লী কাটিপাড়ায় মামা বাড়ি। মাতা জাহ্নবী দেবীর ভ্রাতা বংশীধর ঘোষ। বিদ্যা-বুদ্ধিতে জুড়ি নেই। ভাগ্নের প্রশংসা ও খ্যাতি দেশময় ছড়িয়ে গেছে তা অজানা নেই তার। তিনি জাতপাত তেমন মানেন না। মধুসূদনকে হাত ধরে সোজা নিয়ে গেলেন অন্তঃপুরের খাস কামরায়। একখানি পালঙ্কের ওপর বসিয়ে বল্লেনঃ মধু তুই এখানে বোস। সেই ছেলেবেলায় তোর মা ও আমি দুই ভাই-বোন এইখানে শুতাম।
বংশীধর ঘোষ বাড়ির লোকদের হুকুম দিলেন, মধু কে যেন খাবার দেয়া হয় স্বর্ণপাত্রে। তিনি নিজে সিন্ধুক খুলে সোনার থালা, ঘটিবাটি, গেলাস বের করে দিলেন। কিন্তু বংশীধর বাবুর মতো বাড়িতে আর কেউ উদার হতে পারলেন না। তারা অগোচরে মাটির কলস থেকে জল, কলাপাতায় ভাত খেতে দিলেন মধুকে। কাটিপাড়া থেকে আবার সাগরদাঁতি এলেন মধুসূদন। ছেলেমেয়ে-স্ত্রীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে ক’দিনে। যাবার আগে মধু সারা দুপুর-বিকেল হেনরিয়েটাকে নিয়ে কপোতাক্ষের কূলে বসে থাকতেন। জোয়ার-ভাটা দেখতেন আর বলতেনঃ কপোতাক্ষ, যে তোমার তীরে পাতার কুটিরে বাস করে, সেও পরম সুখী। আমি তোমার কাছেই থাকবো। আমায় ভুলে যেওনা। আমি আবার আসবো তোমার কাছে। বাগেরহাটের ঘাট থেকে আবার ফিরলেন কোলকাতা। সেই থেকে ওই হাটবিহীন ঘাটের নাম বিদায় ঘাট।
কোলকাতা ফিরেই মধুসূদন স্থির করলেন বিলাতে যাবেন। বিলাত যাত্রার আগেই ভবিষ্যতের স্বপ্নে ভরা চিঠি লিখেছেন বন্ধুকে, ‘মাইকেল।
প্রচুর টাকা না হলে জীবনের কোন মূল্য নেই। মানুষের মত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে হলে আরো প্রচুর টাকা প্রয়োজন। আটত্রিশ বছর বয়সেও তাঁর অগাধ টাকার জন্য ব্যরিষ্টারী পড়ার উদগ্র বাসনা। কারণ একজন ব্যরিস্টারের প্রচুর টাকা আয়ের সুযোগ থাকে। হঠাৎ একদিন বন্ধুদের ডেকে সিদ্ধান্ত জানালেন মধুসূদন। পৈতৃক সম্পত্তির যথোপযুক্ত বিলি ব্যবস্থায় বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় পত্তনিদার নিযুক্ত করলেন মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তারা মধুসূদনকে বিলেতে পড়ার খরচ পাঠাবে এবং কোলকাতায় হেনরিয়েটাকে মাসিক দেবে দেড়শো টাকা। চুক্তির ফলে অগ্রিম কিছু টাকা পাওনা থাকলো। পত্তনিদারগণকে মধুসূদন সরল বিশ্বাসে গ্রহণ করলেন এবং অর্থের জন্য নিশ্চিত হলেন। এদিকে পৈতৃক গৃহ বেচলেন বাল্যবন্ধু হরিমোহন বন্দোপাধ্যায়ের কাছে তাও সব টাকা নগদে নয়। পাওনা থাকলো পাঁচশো টাকা। ইতোপূর্বে তাঁর ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, ‘আত্মবিলাপ’, ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক, ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতা প্রকাশ পেয়েছে।
বিলাত যাত্রার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছেন মধুসূদন। পাঁচই জুন (মতান্তরে নয়ই জুন) ‘ক্যানডিয়া’ সিটি বাজিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে নোঙ্গর তুলে বন্দর ত্যাগ করলো ইউরোপের উদ্দেশ্যে। পুত্র-কন্যা-স্ত্রী পড়ে রইলো কলকাতায়। জুলাই মাসে মধুসূদন ইংল্যান্ডে পৌঁছলেন এবং পূর্ব সংকল্প অনুযায়ী ইনার টেম্পলে ভর্তি না হয়ে অবিলম্বে গ্রেজ ইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।
এরপর মাস কয়েক পত্তনিদারণ অর্থ সরবরাহ করলেন। চুক্তি অনুসারে টাকা বিলেতেও গেল, কলকাতায় হেনরিয়েটাও পেল। অজ্ঞাত কারণে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন, পত্তনিদার মহাদেব চাটুজ্যে। পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভুলে গেলেন বৈদ্যনাথ মিত্র ও দিগম্বর মহাশয়। নিদারুণ অর্থ কষ্টে পতিত হলেন প্রবাসে মধুসূদন এবং দেশে কলকাতায় হেনরিয়েটা পত্তনিদারগণ ও প্রতিভূগণ এমন দুর্ব্যবহার করেছেন যে তিনি বাধ্য হয়ে কোন রকমে সামান্য পাথেয় সংগ্রহ করে বিলাত যাত্রা করেন এবং ১৮৬৩ সালের মে মাসের ২ তারিখে ইংল্যান্ড পৌঁছান।
এ সময়ে লন্ডনে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে মধুসূদন চরম আর্থিক অনটনে পড়লেন। ফলে লন্ডনের বাস উঠিয়ে ব্যারিস্টারী পড়ায় ছেদ টেনে প্যারিস গমন করেন এবং কিছুদিনের মধ্যে সেখান থেকে ভার্সেই গিয়ে অত্যন্ত দৈন্য অবস্থায় দিনাতিপাত করতে থাকেন। এ সময়ে শর্মিষ্ঠা ও মিল্টন অনাহারে খাবার জন্য কাঁদতো। কারণ বৎসারাধিককাল দিগম্বর মিত্র টাকা-পয়সা বন্ধ করে রেখেছেন অথচ মধুসূদন মনে করতেন তিনি একজন খাঁটি মানুষ। অহিফেন সেবী বৈদ্যনাথ মিত্র নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছেন পরের টাকায়। পোস্ট অফিসের প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ চিঠির উত্তর দিচ্ছেন, কিন্তু মহাদেব চাটুজ্যে গত পাঁচ-পাঁচটি চিঠির উত্তর দিলেন না আবার ষষ্ঠবার চিঠি লেখা হয়েছে অথচ কোন সাড়া নেই। দিগম্বরকে লিখেছেন আটখানা চিঠি অথচ পাষাণ হৃদয় গলেনি। বুদ্ধিমতি হেনরিয়েটা মধুকে চুরি করে তার গাউন-বিভিন্ন আভরণ, গৃহসজ্জার উপকরণ, বিভিন্ন সময়ে পাওয়া কবির উপহার সামগ্রী এবং পুস্তকাদি বন্ধক ও বিক্রয় করে সংসার নির্বাহ করতেন এবং দারিদ্রের নিদারুণ পরিণতিতেও কোন সময় স্বামীকে গঞ্জনা বা উত্যক্ত করতেন না। দেনার দায়ে অতিষ্ঠ মধুসূদন গ্রেজ-ইন থেকে চারশো পঞ্চাশ টাকা ধার নিয়েছেন। গ্রেজ ইনের জাস্টিসরা তাকে সাসপেন্ড করেছেন ফলে থার্ডটার্ম হারিয়ে গেছে। তার উপর মনো (মনোমোহন ঘোষ) বেচারার কাছে দুইশত পঞ্চাশ টাকা ধার নিয়েছেন। ফরাসী জেলের কড়া নাড়ছে। স্ত্রী ও শিশুরা কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেবে। মধুর শরীরের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। নিজে লিখতে পারতেন না। কলম ধরার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। হেনরিয়েটার অবস্থাও তথৈবচ- সে সন্তান সম্ভবা তবুও মধুর চেয়ে তার অবস্থা কিছুটা ভালো। মধু বলে চলেছেন আর ভদ্র মহিলা তাঁর ডিকটেশনে লিখে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে অবস্থা যখন জোরবার ঠিক তখনই এগিয়ে এলেন একজন সুন্দরী দয়াশীল ফরাসী তরুণী যার সঙ্গে মধুর রেলের কামরায় আলাপ হয়েছিল। ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ এই মহিলা মধুর দুর্ভাগ্যে সান্তনা দিয়েছেন, এমন কি টাকা-পয়সাও দিয়ে সাহায্য করেছেন। বাড়ির মালিকের কাছে নিয়ে এমনভাবে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন যাতে তিনি অব্যহতি পেয়েছেন। বাড়ির মালিক আরো কিছুদিন বাড়িতে থাকতে দিতে রাজী হয়েছেন। একদিন ভার্সেই- এর বাসায় কন্যা শর্মি ও পুত্র মিল্টন ক্ষিধেয় কাঁদছে। মধুসূদন বসে বসে কবিতা লিখছেন। হেনরিয়েটা বলছেঃ পোয়েট না খেতে পেলে তুমি কবিতা লিখবে কি করে ? সব গেছে আমাদের। তোমার টাইপিন, কাফলিংক, আংটি, আমার সব গয়না।
- কিছু ভেবো না ডার্লিং।
-কোলকাতায় মহাদেতব ও দিগম্বর দুই নরপিশাচ আছে। ওরা আমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। আমাদের দেখে কে বলবে কোলকাতায় আমার ত্রিশ হাজার টাকার সম্পত্তি আটকে রেখেছে দিগম্বর মহাশয় ? একটি পয়সা পাঠাচ্ছেন না। কে বলবে মহাদেব চট্টোপাধ্যায় নামে এক বাপিড ভালচার বছরে আমার আঠারো হাজার টাকা মেরে দিচ্ছে ?
- কিন্তু মহামানব বিদ্যাসাগর আছে। হেনরিয়েটা বল্লেন। এমন সময় দরজার কড়া বেঁজে উঠলো। মধুসূদন পাওনাদার ভেবে পালাবেন ভাবছেন। হেনরিয়েটা দরজা খুলে দেখেন প্রতিবেশীরা দোরের কাছে ঝুড়িতে খাবার রেখে গেছে। মধুসূদন এই সময় আনন্দে আত্মহারা হয়ে হেনরিয়েটাকে কাছে টেনে বল্লেনঃ আঁরিয়েত বলছিলাম না এ লন্ডন নয়। এখানকার মানুষ প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজেরা কিছু খায় না। ওরা দেখেছে যে আমাদের চার বছরের ছেলে মেঘনাদ দুধ খেতে পায় না। দুধও দিয়েছে এক বোতল।
আগষ্ট মাসের দুই তারিখে বিদ্যাসাগর মধুসূদনের চিঠি পেয়ে অত্যন্ত বিচলিত হন এবং প্রতিভূগনের উপর নির্ভর না করে আপন চেষ্ঠায় পনেরো শো টাকা সংগ্রহ করে পাঠান এবং পরে অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা এবং শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করলেন। মধুসূদন প্রয়োজনীয় দলিলপত্র পাঠিয়ে দিলে তাঁর পিতৃসম্পত্তি অনুকুলচন্দ্রের কাছে বাধা রেখে আরও বার হাজার টাকা সংগ্রহ করা বিদ্যাসাগরের পক্ষে সম্ভব হয়। মধুসূদন এই অর্থ প্রাপ্তি স্বীকারে বিদ্যাসাগরকে কৃতজ্ঞতা জানান অতিমানব হিসেবে এবং প্রবাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন ও আসন্ন ঋণের দায়ে মামলা এবং জেল থেকে অব্যাহতি পান। পরে আবার ইংল্যান্ড এসে ‘গ্রেজ ইন- এ যোগ দেওয়া সম্ভব হলো এবং আঠারো শো পয়ষট্টি সালের ১৭ই নভেম্বর ব্যারিষ্টারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময়ে মধুসূদন ‘চতুর্দশ পদী’ কবিতা রচনায় হাত দেন। প্রবাসে দৈবের বসে ‘মাতৃভূমির বালসঙ্গী ‘কপোতাক্ষ নদ’ নিয়ে কবিতা রচনা করেন। কয়েকটি নীতিগর্ভ কবিতাও সময়ে লেখা হয়। সে সময়ের কয়েকটি বিশিষ্ট ‘চতুর্দশপদী’ কবিতা বঙ্গভাষা’, অন্নপূর্ণার ঝাঁপি’, ও স্বায়ংকাল’।
১৮৬৭ সাল। জানুয়ারী মাসের ৫ তারিখ। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে ফ্রান্সে রেখে অর্থাভাবে একাকী ভার্সেই বন্দর থেকে কোলকাতা ফিরে আসেন এবং ফেব্রুয়ারী মাসের বিশ তারিখে কোলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টারী শুরু করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান। কিন্তু অবিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করার জন্য নব্য এম, এস, ডাট, বার-এট-ল, কে হাইকোর্টে ব্যারিস্টারী প্রবেশাধিকার প্রশ্নে নানা বাধা-বিপত্তীর সম্মুখীন হতে হয়। অবশেষে এপ্রিল মাসে রাজকালী কৃষ্ণ ঠাকুর, রমানাথ ঠাকুর, রাজেন্দ্রনাথ মিত্রের কাছে মধুসূদনকে সার্টিফিকেটের জন্য ধর্না দিতে হয়। যারা চরিত্রবান নন, সমাজে শুধুই মান্যবর তাদের কাছেই ছুটতে হয় মধুকে চারিত্রিক সনদের জন্য- সেই বাপিড ভালচার দিগম্বর মিত্রের কাছে পর্যন্ত। শেষমেষ বিদ্যাসাগর ও যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর এগিয়ে এলেন। ব্যারিস্টারী পড়ার আগের জীবন ও প্রবাস জীবনের চারিত্রিক সনদপত্র যোগাড় হয়ে গেল। আস্তে আস্তে গণ্যমান্য ব্যক্তির সুপারিশ বাড়তে লাগলো এবং বিরূপ অবস্থার পরিবর্তন সাধিত হলো। প্রায় সাড়ে তিন মাস পরে তিনি হাইকোর্টে বারে প্রবেশাধিকারের অনুমতি পান। বিদ্যাসাগর তাঁর জন্য সুকিয়া ষ্ট্রীটে একটি বাড়ি ঠিক করে রাখলেন। কিন্তু এম, এস, ডাট বার এট-ল এর পক্ষে বাঙালী পাড়ায় থাকা শোভন নয়। তাই তিনি বিলাস বহুল স্পেনসেস হোটেলে তিনটি ঘর নিয়ে কোরকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টারী ব্যবসা শুরু করেন। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। পান ভোজন, বিলিতি খানা, হাইকোর্টের থেকে সামান্য কর্মচারী পর্যন্ত এলাহী কান্ডকারখানা চলছে। তাঁর নিজের প্রায় হাজার টাকা তদুপনি স্ত্রী-কন্যা-পুত্র ফ্রান্সে তাদের মাসিক প্রায় তিনশো টাকা পাঠাতে হচ্ছে। চরিত্রগত অমিতাচার ও অমিতব্যয়িতা তাঁকে মোহাদ্ধ করে তুলেছে। ভগ্ন স্বাস্থ্য স্পেন্সেস হোটেলে নিঃসঙ্গতা, অশান্তি, তদুপরি উত্তমর্ণদের প্রাণান্তকর তাগিদে অতিষ্ঠ হয়ে মধুসূদন বিপদের বন্ধু বিদ্যাসাগরকে চিঠি লেখেন। পুরনো ও নতুন ঋণ নিয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় চিঠি পেয়ে বিপদগ্রস্ত হলেন। মধুসূদন ১৮৬৮ সালে সম্পত্তি সম্পত্তি কুড়ি হাজার টাকায় বিক্রয় করে বিদ্যাসাগরকে বিপদমুক্ত করলেন। সম্পত্তি কিনলেন মহাদেব চাটুজ্যে ও তাঁর পত্নী মোক্ষদা দেবী।
১৮৬৯ সালের মে মাস, পত্নী হেনরিয়েটা পুত্র-কন্যাসহ কোলকাতায় চলে এলেন। মধুসূদন হোটেল ছেড়ে ছয় নম্বর লাউডন ষ্ট্রীটে বাগান ঘেরা দোতলা বাড়ি ভাড়া করলেন। ভাড়া মাসিক চারশো টাকা। রাজকীয় সমারোহে বসবাস চলছে। অস্থিরতা নশ্বর জীবন ভোগে দুর্বার স্পৃহা, আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যতা পাওনাদারদের গঞ্জনায় ব্যারিস্টারী ছাড়তে বাধ্য হলেন মধুসূদন।
১৮৭০ সালে হাইকোর্টের প্রিভিকাউন্সিল আপিলের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষকের পদে চাকরি নেন মধুসূদন। ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বরে “হেকটর বধ” কাব্য পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। আশা-নিরাশার দোলাচালে দেড়-দু’হাজার টাকায় প্রিভিকাউন্সিলের অনুবাদ বিভাগের পরীক্ষকের চাকরি তাঁর প্রত্যাশা ও প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। এবারও তিনি হাইকোর্টের চাকরি ছেড়ে দিলেন।
পরাজিত জীবন সৈনিক কোলকাতা ত্যাগ করলেন। ১৮৭২ সালে মানভূমে পঞ্চকোট রাজ্যের আইন-উপদেষ্টার পদে চাকরি নিলেন। নানা রোগে জীর্ন শরীর। জীবন নিঃশোষিত প্রায়। কিন্তু স্বাধীনচেতা মধুসূদনের পক্ষে এ চাকরি করাও সম্ভব হলো না। তিনি আবার কোলকাতা ফিরে এলেন এবং হাইকোর্টে পুনরায় আইন ব্যবসায়ে প্রত্যাবর্তন করেন। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে একবার ঢাকা গেলেন মামলা উপলক্ষ্যে। ঢাকায় এসে ম্যালেরিয়া হলো। এমনিতে লিভারের অবস্থা ভালো যাচ্ছিলো না। যন্ত্রটি আরো খারাপ হয়ে গেল। ঢাকায় থাকতে হলো প্রায় দশদিন যাবৎ। সম্বর্ধনার উত্তরে একটি ‘চতুর্দশপদী’ লিখেছেন
“নাহি পায় নাম তব বেদে কি পুরাণে
কিন্তু বঙ্গ অলঙ্কার তুমি যে তা জানি
পূর্ববঙ্গে।”
এ ছাড়াও ঢাকাবাসীদের মনোদুঃখ তাদের বক্তৃতায় ফুটে উঠেছিল, “আপনি ইংরাজ হইয়া গিয়াছেন শুনিয়া আমরা ভারি দুঃখিত হই কিন্তু আপনার সঙ্গে আলাপ ব্যবহার করিয়া আমাদের সে ভ্রম গেল”। এর জবাবে মধুসূদন জানালেন, “আমার সম্বন্ধে আপনাদের যে-কোন ভ্রমই হউক আমি সাহেব হইয়াছি এ ভ্রমটি হওয়া ভারি অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ও শয়ন করিবার ঘরে এক একখানি আর্শি রাখিয়া দিয়াছি এবং আমার মনে সাহেব হইবার যেমনি লোভ হয়। অমনি আর্শিতে মুখ দেখি। আরো আমি শুধু বাঙ্গালী নই, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটি যশোহর।
কোলকাতা এলেন খালি হাতে। পাওনাদারেরা তাঁকে ছেঁকে ধরলো। স্ত্রীর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাঁচার আর উপায় নেই । বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখেছেন। আগেরকার মহামানব এবার কঠিন বাস্তব মূর্তি দেখালেন। বিফল মনোরথ হলেন মধুসূদন। বিদ্যাসাগর শিশুপাঠ্য লিখে সচ্ছলতা পেয়েছিলেন। এবার মধুসূদনও শিশুপাঠ্য লেখায় হাত দেবেন? ইতোমধ্যে বেঙ্গল থিয়েটারের জন্য অর্থের বিনিময়ে ‘মায়াকানন’ রচনায় হাত দিয়েছেন এবং ‘বিষ না ধনুর্গুণ’ নামে আর একটি নাটক রচনা আরম্ভ করেছেন। বিদ্যাসাগরের সাথে অর্থের সম্বন্ধ ভেঙ্গে গেছে। গৌর, ভুদেব, কেশব, রাজ, মনু, বঙ্কু আজ কে কোথায়? একদিন দুপুরে স্নেহের মনু মধুকে দেখতে গেল। সমস্ত জানালা বন্ধ করে বদ্ধ ঘরের আলো-ছায়ার মধ্যে একাকী মধুসূদন সরা পান করে চলেছেন, একেবারে নির্জলা সুরা। এ কী আত্মহত্যা না দুঃখ ভুলে থাকা? সুদীপ্ত প্রদীপ এখন নিজেকে পুড়িয়ে শেষ করছে। অচিরাৎ শেষ হয়ে যাবে। এ কি পূর্ব গৃহীত সংকল্প ?
১৮৭৩ সালের এপ্রিল মাস। কালজয়ী মহাপুরুষ যুগসারথি মহাকবি মাইকেল শ্রী মধুসূদন দত্তের জীবনী শক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। অতিরিক্ত সুরাপানে ইজি চেয়ারে সারাক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে থাকেন। লিভারের অবস্থা ভালো নেই- মুখে ঘা দেখা দিয়েছে। ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করার জন্য উত্তন পাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়কে লিখলেন তার লাইব্রেরী ভবনের দুইতলায় কিছুদিন কাটিয়ে আসতে চান। জয়কৃষ্ণ বাবু খুশী মনে রাজী হলেন। কবি সপরিবারে উত্তর পাড়া এসে পৌঁছুলেন। এখানে গঙ্গাতীর আছে। পাশের কামরায় জীবন সাথী হেনরিয়েটা আছেন। পাওনাদাররা এতদূরে এসে কেউ টাকার জন্য জালাচ্ছে না। মে মাস। স্বাস্থ্যের উন্নতি হলো না। ক্রমশঃ মধুসূদনের উত্থান শক্তি রহিত হতে লাগলো। অসুস্থ হেনরিয়েটার গায়ে বিষম জ্বর। এই শ্বেতঙ্গিনী মহিলা হাসি মুখে কষ্ট সহ্য করে চলেছেন। একদিন গৌরদাস মধুকে দেখতে এলেন। তিনি এখন হাওড়ায় বদলী হয়ে এসেছেন। খবর শুনে প্রিয় এবং অকৃত্রিম বন্ধুকে দেখতে এসেই কেঁদে ফেল্লেন। তিনি আরো কিছু বন্ধু-বান্ধব এবং অনুরাগী জনের সহযোগিতায় নিদারুণ পীড়িত অবস্থায় জোর করে কোলকাতায় নিয়ে এলেন। রোগী ও রোগীনীর অবস্থা সংকটজনক। ঘোড়াগাড়ি নিরাপদ নয়। বজরা নিতে হলো। প্রথম যেদিন মধুসূদন কোলকাতা এসেছিলেন বেলেঘাটার খাল দিয়ে- এবার উত্তরপাড়া থেকে কোলকাতা চলেছেন। বাবুঘাটে নামলেন তাঁরা।
ইন্টালীর বেনেপুকুরের বাসাবাড়ি। পাশাপাশি দু’টি ঘর। এক ঘরে হেনরিয়েটার গায়ে বিষম জ্বর। অন্যঘরে চির শয্যায় রোগকাতর ভাগ্য বিড়ম্বিত পরাজিত জীবন সৈনিক মধুসূদন। কি মর্মান্তিক ! মনু, ভূদেব, গৌরদাস দিনরাত্র এসে দেখে-শুনে যান। মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়েও স্ত্রীকে কাছে ডেকেছেন মধুসূদনঃ এসো ডার্র্লিং, আমরা একসঙ্গে অনন্ত লোকে পাড়ি দেই। ভাঙ্গা গলায় অস্ফুট স্বরে আঁরিয়েত বলেছেনঃ মাইকেল আমি তোমার আগেই যেন যেতে পারি। মধুসূদন নিশ্চল হাত দু’খানি বাড়িয়ে দিয়ে কেঁদে ফেল্লেন, আঁরিয়েত তোমার গায়ে জ্বর একি চেহারা হয়েছে তোমার ! ও কিছু না, মাইকেল। তুমি শান্ত হও। হেনরিয়েটা বললেন। ইতোমধ্যে মধুসূদনের অবস্থা উত্তরোত্তর রোগের বৃদ্ধিতে শঙ্কাকুল হওয়াতে প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
এদিকে ইন্টালীর বেনেপুকুরের বাসাবাড়িতে হেনরিয়েটা আছেন। আশ্চর্য জীবনী শক্তি এই মহিলার। তিনি বলেছেন, “আমাকে ছাড়িয়া উহাকে দেখুন, উহার শুশ্রুষা ও যত্ন করুন, আমি মরিতে ভয় করি না”। মৃত্যুর জন্য তাঁকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না। ২৪ তারিখে সকলের অলক্ষ্যে ফিরিঙ্গী কন্যা হেনরিয়েটা পুত্র-কন্যা-জামাতার মায়া কাটিয়ে অসহায়ভাবে চির নিদ্রা গেলেন। হাসপাতালে মৃতুশয্যায় শায়িত মধুসূদন খবর শুনে বললেন, “জগদীশ ! আমাদিগের দুই জনকেই একত্র সমাধিস্থ করিলে না কেন? কিন্তু আমার আর অধিক বিলম্ব নাই আমি সত্বরই হেনরিয়েটার অনুবর্তী হইব।”
আকাশে-বাতাসে তাঁর অনেক স্বপ্ন সাধ বিফলে গুঞ্জরিত হয়। এবার গুঞ্জরিত হলো, দূরে কি নিকটে যেখানে যখন থাকি, ভজিব তোমারে।
লোয়ার সার্কুলার রোডে সমাধি ক্ষেত্রে মহিয়সী মহিলা হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হলো। সমাধি-অনুষ্ঠানে বিদ্যাসাগর, যতীন্দ্রমোহন উপস্থিত ছিলেন কিনা জানতে চাইলেন। তিনি জানলেন, “তাহাদের সংবাদ প্রেরণের সময় হয় নাই।”
২৮ জুন, শনিবার। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় চিকিৎসালয়ে এলেন এবং মধুসূদনের পাশে বসে ধর্ম কথা আলোচনা করে শোনান এবং সময়োচিত প্রার্থনা করান।
২৯ জুন। বেদনা ঘন সকাল। রোববার। গাছের শাখায় কা-কা রব। ‘দিন দিন আয়ুহীন, হীনবল দিন দিন’ গৌরদাস শিয়রে বসে চামচে জল তুলে দিচ্ছেন মুখে। অস্ফুট স্বরে বিড় বিড় করে কিছু একটা বলতে চাইছেন মধুসূদন। প্রাতঃকাল হতেই মধুর জীবনী শক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগলো। নিশ্চল নিশ্চুপ। বেলা দুটো প্রায়। পুত্র-কন্যা-জামাতা সহ বহু সুধীজনের সামনে সেই আয়ত চোখ দু’টি চিরদিনের জন্য মুদিত হয়ে গেল। ১৮৭৩ সালের ৩০ জুন। সোমবার। ধর্মান্তরিত মধুসূদন কোনদিন গির্জায় যাননি অভিযোগ তুলে সমাধি ক্ষেত্রে ধর্মযাজকদেন আপত্তিতে শবদেহ কিছু সময় মর্গে রাখা হয় এবং সমাধি ক্ষেত্রে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। পরে অনেক বিতর্কের পর অপরাহ্নে সেন্ট জেমস চার্চ- ধর্মযাজকের উদ্যোগে খ্রিষ্টীয় রীতি অনুসারে অন্তিম ইচ্ছে অনুযায়ী লোয়ার সার্কুলার রোডে সমাধি ক্ষেত্রে শবদেহ পরিপূর্ণ মর্যাদায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সমাহিত করা হয়।
ওই যে লোকটি মহাশয়ন হতে নিবিষ্ট চিত্তে চির নতুন চিরদিনের পথিকদের আহবান করছেনঃ
দাঁড়াও, পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে। তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এ সমাধিস্থলে (জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরা) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন ! যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ তীরে জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি রাজনারায়ন নামে, জননী জাহ্নবী। |
কান পেতে শুনি থেকে থেকে ভেসে ভেসে আসে কাল থেকে কালে। “জন্মিলে মরিতে হবে- অমর কে কোথা কবে,” দুর্জয় দাঁড়। ভাঙনী কূল। বাদাম তল। আমবন। কপোতাক্ষ নদ। ভাঙ্গা শিবমন্দির। যশোরের সাগরদাঁড়ি।
মধুসূদনের গ্রন্থ তালিকা | ||||
নাম | রচনাকাল | প্রকাশকাল | ||
শর্মিষ্ঠা নাটক |
১৮৫৮ সালের জুনের শেষার্ধ থেকে ডিসেম্বর মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে |
জানুয়ারী ১৮৫৯ | ||
একেই কি বলে সভ্যতা |
১৮৬০ সালের মে মাসের অল্প পরে অল্প সময়ের মধ্যে |
জুন- ১৮৬০ | ||
বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ | ঐ | জুন- ১৮৬০ | ||
পদ্মাবতী নাটক |
১৮৬০-এর মার্চ থেকে মে-র মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে সমাপ্ত |
এপ্রিল-মে ১৮৬০ | ||
তিলেত্তমা সম্ভব কাব্য |
জুলাই ১৮৪৯ এর পূর্বে শুরু ১৮৬০ সালের মধ্যে সমাপ্ত |
মে ১৮৬০ | ||
মেঘনাদ বধ কাব্য | মার্চ ১৮৬০ ডিসেম্বর ১৮৬১ | ৪টা জানুয়ারী ১৮৬১ | ||
১ম খন্ড (১ম-৫ম সর্গ) | ||||
২য় খন্ড | ১৮৬১ এর ফেরুয়ারী | জুন - ১৮৬১ | ||
(৬ষ্ঠ-৯ম সর্গ) | সমাপ্ত | |||
ব্রজাঙ্গনা কাব্য | এপ্রিল ১৮৬০ এর মধ্যে সমাপ্ত | জুলাই - ১৮৬১ | ||
কৃষ্ণকুমারী নাটক | ৬ই আগষ্ট-৭ই সেপ্টেম্বর ১৮৬০ | শেষ ভাগে ১৮৬১ | ||
বীরাঙ্গনা কাব্য |
১৮৬১ সালের শেষে বা ১৮৬২ সালের প্রারম্ভে সমাপ্ত |
ফেব্রুয়ারী ১৮৬২ | ||
চতুর্দশপদী কবিতাবলী | ১৮৬৩-১৮৬৫-এর মধ্যবর্তী সময়ে | আগষ্ট ১৮৬৬ | ||
হেক্টর বধ | ১৮৬৭ সালের মধ্যে | ১লা সেপ্টেম্বর ১৮৭১ | ||
মায়াকানন | জীবন সায়াহ্নে | ১৮৭৪ সাল | ||
অসম্পূর্ণ বাংলা রচনাবলী
|
||||
নাম | শ্রেণী পরিচয় | রচনাকাল | ||
সুভদ্রা | নাট্য কাব্য | ১৮৫৯-১৮৬০ | ||
রিজিয়া | নাটক | ১৮৬০ | ||
ব্রজাঙ্গনা কাব্য ২য় সর্গ। বিহার |
কবিতা |
এপ্রিলের পূর্বে ১৮৬০ |
||
সিংহল বিজয় | মহাকাব্য | ১৮৬১ সালের মাঝা-মাঝি | ||
বীরাঙ্গনা কাব্য ২য় খন্ড |
কবিতা | ১৮৬২ সালের ফেব্রুয়ারী | ||
দ্রৌপদী স্বয়ম্বর | ||||
মৎস গন্ধা (কাব্য) | মহাভারতে উল্লেখিত | ১৮৬৩-১৮৬৪ | ||
সুভদ্রা হরণ | বিবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে | |||
পাণ্ডব বিজয় | ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাহিনী | |||
দুর্যোধনের মৃত্যু | কাব্য বা মহাকাব্য | |||
বিষ না ধনুর্গুন | নাটক | জীবন সায়াহ্নে | ||
দেব দানবীয়ম | ব্যঙ্গ কবিতা | জীবন সায়াহ্নে | ||
নীতিগর্ভ কবিতাবলী | কবিতা | জীবন সায়াহ্নে | ||
বিবিধ কবিতাবলী | কবিতা | বাল্য ও পরবর্তীকালে | ||
ইংরেজী রচনাবলী | ||||
CAPTIVE LADIE (POETRY) | ১৮৪৮ সালের ২৫ শে নভেম্বর পূর্বে লেখা। | |||
VISIONS OF THE PAST (POETRY) | ১৮৪৯ | |||
THE ANGLO-SAXON AND THE HINDU (Lecture- 1) | ১৮৫৪ সালের পূর্বে রচিত ও প্রদত্ত বক্তৃতা | |||
RIZIA t EMPRESS OF INDE (DRAMA) | মাদ্রাজ জীবনের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত | |||
POEMS | ১৮৪১-১৮৪৮ | |||
OTHERS POEMS | ১৮৪৮-১৮৫৬ | |||
নাট্যানুবাদ | ||||
RATNAVALI | ১৮৫৮ সালের জুলাই | |||
Sermista (Author’s translation of his Sarmistha) | ১৮৫৯ | |||
NIL DURPUN, OR The Indigo Planting Mirror, A Drama, Trans, from the Bengali by A Native with an introduction by the Rev. J. Long. | ১৮৬১ | |||
অসম্পূর্ণ ইংরেজী রচনাবলী | ||||
TILLOTTOMA (Poem) | স্ব-লিখিত কাব্যের স্বীকৃত অনুবাদ | |||
QUEEN SITA (Poem) | রামায়ণ কাহিনী অবলম্বে কাব্য সৃষ্টির প্রয়াস | |||
OPSORI | পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বে কাব্য সৃষ্টির প্রয়াস |
![]() |
![]() |
তথ্য সূত্র :
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী
/
রেখো মা দাসেরে মনে
লেখক: আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীর
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান (বিপুল)
সর্বশেষ আপডেট :
অক্টোবর ২০১১
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী
/
রেখো মা দাসেরে মনে
লেখক: আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীর
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান (বিপুল)
সর্বশেষ আপডেট :
অক্টোবর ২০১১
More information about Michel Madhusudan Dutta
bn.wikipedia.org
milansagar.com
banglalibrary.evergreenbangla.com
priyokobita.wordpress.com
goonijon.com
sahityacafe.com
bn.wikipedia.org
milansagar.com
banglalibrary.evergreenbangla.com
priyokobita.wordpress.com
goonijon.com
sahityacafe.com