
Home সাহিত্যিক / Litterateur > আব্দুর রউফ / Abdur Rouf (1902 -1971)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 87149 বার পড়া হয়েছে
আব্দুর রউফ / Abdur Rouf (1902 -1971)
আব্দুর রউফ
Abdur Rouf
Home District: Jessore, Chowgacha
Abdur Rouf
Home District: Jessore, Chowgacha
পরিবা

উপ-মহাদেশের অন্যতম কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক আব্দুর রউফ মরহুম আব্দুর রউফ ১৯০২ সালের ২রা ডিসেম্বর যশোরের চৌগাছার নারায়ণপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুল জলিল বিশ্বাস চৌগাছার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর চাচা খানসাহেব জনাব আব্দুল আজিজ তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন।
আব্দুর রউফ সাত পুত্র ও পাঁচ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর বড় পুত্র মরহুম গোলাম মাজেদ যশোরের দৈনিক রানার ও সাপ্তাহিক গণমানষ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। অন্যান্য পুত্ররা হচ্ছেন মো: রবিউল ইসলাম, এ্যড. মরহুম মো: কামরুজামান, অধ্যাপক মো: নূরুজ্জামান, মেজর (অব:) মো: আসাদুজ্জামান (মুক্তিযোদ্ধা), মো: মনিরুজ্জামান ও মো: নদিরুজ্জামান (যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা) এবং কন্যারা হচ্ছেন শাজেদা খাতুন, শামসুন্নাহার, মরহুমা আফরোজা সুলতানা, ফিরোজা সুলতানা ও ইরিন আক্তার (কানাডার বাসিন্দা)।
শিক্ষাজীবন:
অব্দুর রউফ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯১৯ সালে এন্ট্রান্স, ১৯২১ সালে আই. এ. এবং ১৯২৩ সালে বি. এ পাশ করেন। প্রত্যেক শ্রেণীতেই তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি বি. টি পাশ করেন। সেই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবিভক্ত বাংলায় বি. এ. শ্রেণীতে মাত্র দুই জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তার মধ্যে জনাব আব্দুর রউফ একমাত্র মুসলমান ছাত্র যিনি এই কৃতিত্বের অধিকারী। আই. এ শ্রেণীতে পড়ার সময় শিক্ষা বিভাগ আয়োজিত "Secondary Schools as were and as are in Bengal" শীর্ষক রচনা প্রতিযোগিতায় অবিভক্ত বাংলায় তিনি ১ম স্থান অধিকার করেন। অত:পর তিনি কলকাতা ক্যাম্বেল মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রে লেখাপড়া শুরু করেন। তিন বছর পর এ্যলোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে শেষবর্ষে তিনি কলেজ ত্যাগ করেন এবং ডাক্তার বটব্যালের উৎসাহে দেশীয় গাছ-গাছড়া হতে ‘ইউনিপ্যাথি চিকিৎসা’ নামে এক আদর্শ চিকিৎসা ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন। গত ৭ দশকের বেশী সময় যাবৎ এই ঔষধ গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে স্বল্পমূল্যে সেবা দান করে আসছে। বর্তমানেও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এই ঔষদের প্রচলন আছে।
সাহিত্যকর্ম:
সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ। তাঁর রচিত মোট ৮টি বই এর মধ্যে ৭টি কলকাতা হতে প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে রয়েছে :
১) কাব্যগ্রন্থ ‘অশ্রু সেতার’ (১৯৩৬ কলকাতা),
২) উপন্যাস ‘বাসরে’ (১৯৩০ কলকাতা),
৩) সামাজিক উপন্যাস ‘পথের ডাকে’ (১৯৩৩ কলকাতা),
৪) ‘নিয়তি’ (১৯৩৬),
৫) ‘মৌলভী সাহেব’ (১৯৩৭),
৬) স্বাধীনতার পথ’(১৯৪৬),
৭) ছোট গল্পের সংকলন ‘ভিন জাতের মেয়ে’ (১৯৩৫)।
৮) প্রবন্ধ ‘যুগের ডাক’,
৯) এর অনুবাদ গ্রন্থ ‘The call of the Day’ (নোবেল কমিটি কর্তৃক গৃহীত)
১০) মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত তাঁর হাতে ছিল "The happier humanity" বইটির পান্ডুলিপি।
গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এই মনীষী কতটা সোচ্চার ছিলেন নীচের কয়েকটি কথায় সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন তিনি তার ‘যুগবাণী’তে বলছেন-
...রাজনীতি স্বাধীনতা অপেক্ষা চিন্তার স্বাধীনতার কম মূল্যবান নয়। কেননা মানুষ যাহা লইয়া মানুষ তাহা তাহার মস্তিস্ক। এই মস্তিস্ক যদি কতগুলো বাঁধাবুলি ও কুসংস্কারের আবর্জনায় আবদ্ধ থাকে মানসিক শক্তির অভাবে মানুষের মনুষ্যত্ব হইয়া পড়ে শোচনীয়রূপে পঙ্গু-বিকল। মস্তিস্ক ও চিন্তাহীন মানুষে-পশুতে প্রভেদ নাই।
মানাটায় বড় নয়। না মানতে পারাটাও বড় শক্তির পরিচয়। বস্তুত পৃথিবীকে যারা বড় করিয়েছেন তাহারা এই না মানার দলই। হযরত মোহাম্মদ (সঃ), বৃদ্ধ, খ্রিস্ট ও আরো অনেকের স্ব-স্ব পৈতৃক ধর্মকে অমান্য করিয়াই পরবর্তী জগতে ধর্মগুরু হইতে পারিয়াছেন। সত্যের সীমা নাই, ধর্মের বিকাশেরও তেমনি শেষ নাই। সুতরাং ধর্ম লইয়া যেমন কলহ আছে ধর্মের নবরূপ উন্মেষেরও তেমনি অবকাশ আছে।
তিনি ১৯৩৩ সালে কলকাতায় অবস্থানকালে তাঁর লেখা প্রকাশিত উপন্যাস ‘পথের ডাক’ মৌলবাদী গ্রুপের মধ্যে বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলে কিছু দিনের জন্যে তিনি কলকাতা ছাড়তে বাধ্য হন। পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাঁর লেখা "The call of the day" বইটির মূল বিষয়বস্তু ছিল গ্রাম উন্নয়নের মাধ্যমে কিভাবে দেশের উন্নয়ন সম্ভব। বইটি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নজর কেড়েছিল। জনাব আব্দুর রউফ পাকিস্তান লেখক সংঘের আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।
পেশাগত জীবন:
মরহুম আব্দুর রউফ বি. এ ইন এডুকেশন পাশ করে শিক্ষকতাকে গ্রহণ করেন। কলকাতা মডেল হাই স্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক হিসাবে তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। বিভিন্ন স্কুলে কৃতিত্বের সাথে শিক্ষকতা করেন। সর্বশেষে তিনি যশোর জিলা স্কুলের ইংরেজী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং এখান থেকেই ১৯৫৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর অবসর গ্রহণ করেন অত:পর যশোর শহরের চাঁচড়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য:
তিনি ছিলেন একজন সু-সহিত্যিক, কর্তব্যনিষ্ঠ আদর্শ শিক্ষক। প্রচন্ড আর্থিক কষ্টের মধ্যদিয়েও তিনি গরীব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা পড়ার জন্যে সাধ্যমত অর্থ ব্যয় করেছেন। তাঁর প্রচেষ্ঠায় গড়ে উঠেছে কয়েকটি স্কুল। তিনি ছিলেন একজন উদার মানষিকতা সম্পন্ন ও প্রচন্ড হৃদয়বান ব্যক্তিত্ব। তাঁর উদরতার কথা আজও বহু মানুষের কাছে স্মরনীয়।
মৃত্যু:
এই মহান মনীষী কবি, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক আব্দুর রউফ ১৯৭১ এর ৪ এপ্রিল সকালবেলা যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসা ও মসজিদের ২৪ জন মুসল্লিসহ পাকসেনাদের ব্রাশ ফায়ারে প্রাণ হারান। রেলস্টেশন আলিয়া মাদ্রাসার মধ্যেই আব্দুর রউফ সহ ২৪ জনকে একসাথে সমাহিত করা হয়।
তথ্য সূত্র:
যশোর ইতিবৃত্ত
লেখক: মনোরঞ্জন বিশ্বাস
ঝিনাইদহের ইতিহাস
এম. এম. আল-ফারুক
জেলা প্রশাসক, ঝিনাইদহ
শিক্ষালয়ের ইতিকথা
লেখক: শওকত শাহী
দক্ষিণের জনপদ
ফকরে আলম
সম্পাদনা:
মোঃ হাসানূজ্জামান (বিপুল)
সর্বশেষ আপডেট :
ফেব্রুয়ারী ২০১২
ইউনুচ আলী