
Home সাহিত্যিক / Litterateur > অরুণাচল বসু / Arunachal Basu (1924-1975)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 84857 বার পড়া হয়েছে
অরুণাচল বসু / Arunachal Basu (1924-1975)
অরুণাচল বসু
Arunachal Basu
Home District: Jessore, Monirampur


ছোটো থেকেই আঁকা এবং লেখার প্রতি সহজাত প্রতিভা লক্ষ করা গেছিল তাঁর মধ্যে; মাত্র ছ-বছর বয়েসেই কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। একই সাথে তিনি চিত্রশিল্পী হিসাবেও বেশ পরিচিতি লাভ করেন। বেলেঘাটার দেশবন্ধু হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে আলাপ অভিন্নহৃদয় বন্ধু সুকান্ত ভট্টাচার্যের সাথে— এর পরেই দুজনে একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠেন। অরুণাচল বসু ছিলেন কবি সুকান্ত'র ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সুকান্তের কিশোর বাহিনী'র যশোরের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন। সুকান্ত সমগ্রতে যতগুলি চিঠি আছে, তাঁর বেশিরভাগটাই অরুনাচল বসুকে লেখা। সেই চিঠি থেকে জানা যায়, সেই সময়ের যশোরের বিখ্যাত তরুণ কবিদের মধ্যে অরুনাচল ছিলেন অন্যতম।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দীর্ঘদিন কবিতা, গান, ছড়া ইত্যাদি লিখেছেন। চীন, তুর্কী এবং রুশ ভাষার বহু কবিতাও তিনি অনুবাদ করেছেন। সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা, দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ, সামাজিক ও সাংগঠনিক কাজ করতে পারদর্শী ছিলেন তিনি। সাম্যবাদ, প্রগতিশীল চেতনার কবির লেখা অনেকগুলির মধ্যে- পলাশের কাল, দুরান্ত রাধা, কবি কিশোর সুকান্ত, সুকান্ত জীবন ও কাব্য, রুশদেশের কবিতা সংকলন, মা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যশোরে 'নতুন সংস্কৃতি' নামক একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও মূল সংগঠক ছিলেন বলে জানা যায়। যশোরে বেশ কিছু সমাজসেবামূলক কাজ, কবি সম্মেলন, কিশোরদের জন্য ছড়া পাঠের আসর করেছিলেন তিনি।

মেঘ না-হ’লে কি বিদ্যুৎ জমে
আকাশ কি হয় দীর্ণ—
ছিঁড়ে চলে যাবো, হোক না জীবন
কণ্টক সমাকীর্ণ।
কবির জীবিতকালে মাত্র দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল— ‘পলাশের কাল’ ও ‘দূরান্ত রাধা’; এ ছাড়া ‘কবি কিশোর সুকান্ত’ (সরলা বসুর সাথে), ‘সুকান্ত : জীবন ও কাব্য’ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর কবিতায় যেমন ছিল গীতিময়তা বা কাব্যমাধুর্য, তেমনই ছিল দেশাত্মবোধ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পলাশের কাল’ প্রসঙ্গে সমালোচক বলেছিলেন: “সুকান্তর সঙ্গী হয়েও অরুণাচলের কবিতা... সুকান্তর থেকে সুরে, শব্দে ও চিত্রে আশ্চর্য পৃথক।” প্রচুর গানও লিখেছিলেন তিনি।
অনুবাদক হিসাবে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মূলত রাশিয়ান কবিতার অনুবাদ করলেও অন্যান্য দেশের কবিতাও বাদ যায়নি। প্রায় সাঁইত্রিশ বছর ধরে রচিত তাঁর কাব্যচর্চার ফসল বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং পাণ্ডুলিপিতে ছড়িয়ে রয়েছে। এ ছাড়াও রয়ে গেছে তাঁর আঁকা বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ আর প্রচুর ছবি। মৃত্যুর প্রায় সাতাশ বছর পরে তাঁর রচিত কবিতা, গান ও অনুবাদ নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ‘অরুণাচল বসুর সংকলিত কবিতা’ নাম দিয়ে।
যে সমস্ত পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশ পেয়েছে, তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হ’ল: কিশোর সভা, কিশোর, নতুন দিন, কবিতা, পরিচয়, সৃজনী, কবিকণ্ঠ, কেতন, দিগন্ত, অগ্রণী, ডাক, প্রান্তিক, নান্দীমুখ, উত্তরসুরি, একক, নতুন সাহিত্য, সীমান্ত, রংমশাল, সবুজ পত্র, সঙ্কেত, পদাবলী, স্বাক্ষর, অভিমত, ইস্পাত, বাঙলা দেশ, কালান্তর, রুশভারতী, প্রতীতি, অভিজ্ঞান, সোভিয়েত দেশ, প্রভৃতি।
বিভিন্ন সংকলনেও তাঁর কবিতা স্থান করে নিয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হ’ল:
· হাজার বছরের প্রেমের কবিতা (১৯৬১) — সম্পাদনা : অবন্তী সান্যাল (তিনটি জাপানী কবিতার অনুবাদ)
· একালের কবিতা (১৯৬৩) — সম্পাদনা : বিষ্ণু দে (কবিতা: তুমি তো আকাশ আজ)
· প্রেমের কবিতা (১৯৬৩) — সম্পাদনা : সুকুমার ঘোষ (কবিতা: কত নীল রাত হাওয়ায় হারালো)
· মৌন মিছিল (১৯৬৬) — সম্পাদনা : সুবোধ রায়, খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত (কবিতা: এত জলে)
· সেরা রংমশাল (২০০৩) — সম্পাদনা : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (কবিতা: গান ও তীর)
তাঁর আর একটি পরিচয়— তিনি ছিলেন সংগ্রাহক। বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও দেশ-বিদেশের বেশ কিছু আঁকা ছবির কপি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন।
তাঁর জীবনের অন্যতম কৃতিত্ব— ‘নতুন সংস্কৃতি’ (সাহিত্য ও সংগীত বিভাগ) নামক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা। সচেতন এক মানবিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন। বাংলার সংগীতপ্রেমীদের কাছে ‘নতুন সংস্কৃতি’ এক ঝলক টাটকা বাতাস বয়ে নিয়ে এসেছিল ‘আধুনিক বাংলা কবিতার সংগীতরূপ’ অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে। আধুনিক বাংলা কবিতার সংগীতরূপ দেওয়ার ব্যাপারে তিনিই ছিলেন পথিকৃৎ। শেষজীবনে কবি থেকে তাঁর রূপান্তর ঘটেছিল সংগঠক হিসাবে।
সবাইকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ; ছোটো-বড়ো সবার সাথেই মিশতে পারতেন বন্ধুর মতো। সমসাময়িক প্রথিতযশা কবিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন তাঁর বন্ধুস্থানীয়। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে কবির এই সংগ্রামী কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে। অগণিত গুণগ্রাহীকে ফেলে রেখে— সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই (বাংলা ৭ শ্রাবণ ১৩৮২) তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
তথ্য ও ছবি সংগ্রহ:
দীপক রায়
নদীয়া, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত
সর্বশেষ আপডেট :
নভেম্বর ২০১১